ঢাকা শনিবার, ২৭শে জুলাই ২০২৪, ১৩ই শ্রাবণ ১৪৩১

খুলনা জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে কমছে কৃষি উৎপাদন


প্রকাশিত:
১৭ মে ২০২৪ ১৭:০৪

আপডেট:
২৭ জুলাই ২০২৪ ১৫:০৯

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খুলনা অঞ্চলে কৃষির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। আবহাওয়ার ধরনে পরিবর্তন হওয়ায় দিন দিন তাপমাত্রা বাড়ায় ফসলের উৎপাদন কমছে। একইসঙ্গে এই অঞ্চলে ফসল নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। জলবায়ুর এই সংকটে আগামী দিনে খাদ্য উৎপাদন মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারে আশঙ্কা করছেন জলবায়ু ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং কৃষি কর্মকর্তারা।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে আগামী দিনে পশুপালনের পাশাপাশি খাদ্যশস্য উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। অনেক এলাকায় ব্যাপক আকারে পানিস্বল্পতা দেখা দিতে পারে। এবারের তীব্র গরমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, পানি, প্রতিবেশ ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারযোগ্য পানির সংকট প্রকট করে তুলেছে। গত ২৫ বছরে খুলনা অঞ্চলে তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। ২০১১ সালে এই অঞ্চলের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ছিল ৩১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি বছর সেই তাপমাত্রা ছাড়িয়েছে রেকর্ড অর্থাৎ ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এতে উপকূলীয় এই অঞ্চলে দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে এমন তাপমাত্রার কারণে হুমকির মুখে পড়ছে কৃষি, মৎস্যসহ উৎপাদন খাত। তাই এখনই এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ।

উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বসবাস করছেন দক্ষিণ-পশ্চিমের উপকূলের মানুষজন। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে জীবন-জীবিকা। লবণাক্ততার কারণে জমিতে ফসল ফলাতে পারছেন না, উর্বরতা হারাচ্ছে কৃষিজমি। গৃহপালিত পশুর খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।

খুলনা আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে গত ১৫ বছরে এক ডজনের বেশি দুর্যোগের কবলে পড়েছে উপকূল। ২০১৩ সালে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন, ২০১৫ সালে কোমেন, ২০১৬ সালে রোয়ানু, ২০১৭ সালে মোরা, ২০১৯ সালে ফণী, ২০১৯ সালে বুলবুল, ২০২০ সালে আম্পান, ২০২১ সালে ইয়াস, ২০২২ সালে অশনি ও সিত্রাং। এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফল।

বছর বছর বাড়ছে তাপমাত্রা উল্লেখ করে খুলনা আবহাওয়া অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ বলেন, ‘খুলনায় গত ১ মে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। ২৯ এপ্রিল রেকর্ড হয়েছিল ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২৫ এপ্রিল রেকর্ড হয়েছিল ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি, ২০১৪ সালের ২৩ এপ্রিল ৪০ দশমিক ৭ ডিগ্রি, ২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি, ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল ও ২০০২ সালের ২০ মে ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল। হিসাবে প্রতি বছরই তাপমাত্রা বাড়ছে।’

উপকূলের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ঘন-ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনিয়ন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, চিংড়ি ঘেরে উঁচু বাঁধ না দেওয়া, নদী প্রবাহ আটকে দেওয়া, পুকুর ভরাট ও সরকারি খালগুলো বেদখলের কারণে প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় পানির তীব্র সংকটের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন তারা। সাধারণত শীত মৌসুম থেকে বর্ষা আসার আগ পর্যন্ত একটা লম্বা সময় এই দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাদের।

বর্ষা মৌসুম শেষে এবারও উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় পানি, প্রতিবেশ ও স্থানীয় কৃষির বিদ্যমান সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। ২০০৯ সালে আইলার পর থেকে প্রাকৃতিক পানির সংকট দেখা দেয়। গভীর নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গত দেড় দশকে পানির সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে কয়রার শাকবাড়িয়া, বেদকাশি, কয়রা সদর, সাতক্ষীরার গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, কৈখালী, রমজাননগর, তালার বিভিন্ন গ্রাম, বাগেরহাট সদর, মোংলা ও শরণখোলা এলাকায় পানির সংকট তীব্র।

স্থানীয়রা বলেন, ‘খরা, ঝড়, বৃষ্টি ও নদীভাঙন আমাদের নিত্যসঙ্গী। আইলার পর থেকে গোটা এলাকা উদ্ভিদশূন্য। লবণাক্ততার কারণে সব গাছ মারা গেছে। এলাকায় বসবাস করা খুবই কষ্টের। সবসময় পানির অভাবে থাকতে হয় আমাদের।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, সাতক্ষীরার এক লাখ ৮৮ হাজার ৬২৬ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে ৮১ শতাংশের বেশি অর্থাৎ এক লাখ ৫৩ হাজার ১১০ হেক্টর লবণাক্ততায় রূপ নিয়েছে। আর পতিত জমি রয়েছে ৪০ হাজার ৯৮১ হেক্টর। বন্যা, খরা ও জলাবদ্ধতার পাশাপাশি মাটি ও পানির লবণাক্ততা বেড়েছে। এতে ক্রমেই ধানের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। গত চার বছরে আমন উৎপাদন কমেছে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন।

সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ মৌসুমে জেলায় আমন উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ৭৫ হাজার ৮৬ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ মৌসুমে উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ৫৮ হাজার ১০০ মেট্রিক টন, ২০২১-২২ মৌসুমে উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ৪৬ হাজার ৭২৮ মেট্রিক টন এবং ২০২২-২৩ মৌসুমে আমন উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ৪১ হাজার ৮৫৮ মেট্রিক টন। হিসাবে ২০১৯-২০ মৌসুমের তুলনায় ২০২২-২৩ মৌসুমে ৩৩ হাজার ২৩৮ মেট্রিক টন উৎপাদন কমেছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর বলছে, প্রতি লিটার পানিতে শূন্য থেকে ১ হাজার মিলিগ্রাম লবণ থাকলে সে পানি পানযোগ্য। কিন্তু উপকূলে প্রতি লিটার পানিতে এক হাজার থেকে ১০ হাজার মিলিগ্রাম লবণ রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব পড়ছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় উল্লেখ করে জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন বলেন, ‘ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা ও মাটির লবণাক্ততা উপকূলের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শীতের সময় অধিক শীত, গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরম এবং বর্ষায় অতিবৃষ্টির ফলে দুর্ভোগ বাড়ছে। এছাড়া জলোচ্ছ্বাসে নদীভাঙনে এসব এলাকার বহু মানুষ উদ্বাস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে বর্তমান সময়ে সাতক্ষীরার মানুষ রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রা অনুভব করছে।’

সাধারণত ধান চাষের ক্ষেত্রে ১৮ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন জানিয়ে খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘কিন্তু এর বেশি তাপমাত্রা থাকায় ধান উৎপাদন কমছে। বর্তমানে বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়াচ্ছে। এতে ধানের পরাগায়ণ বাধাগ্রস্ত ও কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।’

বাগেরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক শঙকর কুমার মজুমদার জানিয়েছেন, জেলায় ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। ৭৫ শতাংশ ধান কর্তন শেষ। বাকি ২৫ শতাংশ তাপপ্রবাহের কবলে পড়েছে। এ কারণে ক্ষতির মুখে পড়ছেন কৃষকরা। অনাবৃষ্টি ও তাপপ্রবাহের কারণে জেলায় সবজি চাষ বিলম্বিত হয়েছে। মে মাসের শুরুতে বিভিন্ন সবজি বাজারে আসার কথা ছিল। কিন্তু আসেনি।’

জানতে চাইলে মৃত্তিকা বিভাগের খুলনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জি এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিজমির লবণাক্ততা বাড়ছে। ফলে ফসল উৎপাদন ক্ষমতা দিন দিন কমছে। অনেক কৃষিজমি লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। লবণাক্ততা বাড়তে থাকলে কৃষি আয় বছরে ২১ শতাংশ কমে যাবে। উপকূলীয় অঞ্চলের ৪০ শতাংশ কৃষিজমি হুমকির মুখে পড়বে। এতে এ অঞ্চলের দুই লাখ ৪০ হাজার কৃষকের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনাবৃষ্টির কারণে ধান ছাড়াও অন্যান্য শস্য; যেমন পাট, গম, ভুট্টা, মটর ও ছোলা উৎপাদনও কমছে।’

পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. এমদাদুল হক বলেন, ‘বায়ু মন্ডলের ৯৯.৩ শতাংশ কার্বন প্রাকৃতিক। আর জ্বালানির মাধ্যমে মানুষ থেকে আসে মাত্র দশমিক ৫.৭ শতাংশ। এটাই আমাদের উদ্বেগের জায়গা। বায়ুমন্ডলে কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে পলিথিন উৎপাদন, ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো থেকে। দেশে ১০০ টন পলিথিন ব্যবহার হয়। যার ৫০ শতাংশ দেশে উৎপাদন হয়। বাকি ৫০ শতাংশ বাইরে থেকে আসে। এ ব্যবহার বন্ধ করতে অভিযান, জেল জরিমানা করা হচ্ছে। পৃথিবী তার কক্ষপথ পরিবর্তন করলে জলবায়ু পরিবর্তন হবে। দশমিক ৭ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড মনুষ্যসৃষ্ট কারণে হয়। এটি রোধ করতে হবে।’

 


বিষয়:



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top