ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ই এপ্রিল ২০২৪, ৪ঠা বৈশাখ ১৪৩১

সাভারের আমিনবাজার এলাকায় নির্বিচারে জলাধার ভরাট


প্রকাশিত:
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০১:৩৪

আপডেট:
১৬ এপ্রিল ২০২৪ ১১:২০

সাভারের আমিনবাজার এলাকায় নির্বিচারে জলাধার ভরাট

 

 



গুগল আর্থের ২০১০ সালের ছবিতে সাভারের আমিনবাজার এলাকায় কিছু জলাভূমি ছিল। বর্তমানের ছবিতে সেই জলাভূমি আর নেই। ভরাট হয়ে গেছে প্রায় সব অঞ্চল। এখন সেখানে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন, সরু রাস্তা, কলকারখানা ইত্যাদি। এই এলাকার ঈদগাহ মসজিদের পাশে সম্প্রতি কথা হয় ৭০ বছর বয়সী মফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, একসময় এদিকে অনেক পুকুর, ডোবা, খাল-বিল, নালা ছিল। ৩৫-৪০ বছর ধরে চোখের সামনে একের পর এক সব ভরাট হয়ে গেছে।

এ অবস্থায় বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব জলাভূমি দিবস। ১৯৯৭ সাল থেকে ২ ফেব্রুয়ারি আইইউসিএন, ইউনেস্কোসহ পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন দেশে বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হচ্ছে। এসব কর্মসূচি পালনের মূল লক্ষ্য পরিবেশ রক্ষায় জলাভূমি সংরক্ষণ করা।

বিশ্নেষকরা বলেন, আইনের ফাঁকফোকর ও তা প্রয়োগের উদাসীনতায় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কমছে প্রকৃতির আধার জলাভূমি। কমছে পানির স্তর। ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে পরিবেশ। গত বছর প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাদেশে প্রতিবছর ৪২ হাজার একর জলাশয় ও কৃষিভূমি ভরাট হচ্ছে।

প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এ বলা হয়েছে, নদী, খাল-বিল, হাওর, দিঘি, ঝর্ণা, বন্যাপ্রবাহ এলাকা, বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন সব এলাকা প্রাকৃতিক জলাধার, জলাশয় বা জলাভূমি হিসেবে পরিগণিত হবে। গত বছরের ২২ অক্টোবর ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরকেও প্রাকৃতিক জলাধারের সংজ্ঞাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে যে, এই জলাধার কোনোভাবেই ভরাট করা যাবে না।

 

বিশ্নেষকরা জানান, জলাভূমি সংরক্ষণে সচেতনতা নেই বললেই চলে। বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সারাদেশে প্রশাসনের সামনেই পুকুরসহ জলাভূমি ভরাট করে ঘরবাড়ি-কলকারখানাসহ নানা অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। কোথাও কোথাও জলাশয় ভরাট করে সরকারি অবকাঠামোও গড়ে উঠেছে।

জলাশয় ভরাটের চিত্র : গত বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণা প্রতিবেদনে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় জলাশয় ভরাটের চিত্র উঠে এসেছে। স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্নেষণ করে গবেষণায় বলা হয়, ২০১০ সালে যখন ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) করা হয়, তখন মূল ঢাকা শহরে জলাভূমি ছিল ৯ হাজার ৫৫৬ একর। ২০১৯ সালে এটি কমে হয়েছে ছয় হাজার ৭৩ একর। ৯ বছরে ভরাট হয়েছে মোট জলাভূমির ৩৬ শতাংশ। এই সময়ে সাভারে মোট জলাভূমির ১৫ শতাংশ, গাজীপুরে ১৭ শতাংশ, রূপগঞ্জে ৪১ শতাংশ ও কেরানীগঞ্জে ২১ শতাংশ ভরাট হয়েছে। এই হিসাবে ড্যাপ বা ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় নির্ধারিত এক লাখ ৯৩৭ একর জলাভূমির মধ্যে ২০১৯ সাল নাগাদ ভরাট হয়েছে ২২ হাজার ৫১৬ একর, যা মোট জলাভূমির প্রায় ২২ শতাংশ। ছয়টি এলাকায় মোট ৪১ শতাংশ জলাধার ভরাট হয়ে গেছে।

প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, সারাদেশে প্রতিবছর ৪২ হাজার একর কৃষিজমি ও জলাশয় ভরাট হচ্ছে। ভরাটের মাত্রাও দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে, ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে পাঁচ হাজার ৭৫৭ একর জলাভূমি ভরাট হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এতে প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও নগরের ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি শহরের বৃষ্টির পানি সুষ্ঠু নির্গমনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, আদর্শ একটি শহরের ১০-১৫ শতাংশ এলাকা জলাশয় থাকা প্রয়োজন; কিন্তু ঢাকা শহরে জলাভূমির পরিমাণ প্রায় ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা ২০ বছর আগে ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ ছিল বলে বিআইপির গবেষণায় বলা হয়েছে।

২০১০ সালের ড্যাপে রাজউকের আওতাধীন ৩৭ লাখ ৭ হাজার ৫৭৭ একর জায়গার মধ্যে বন্যাপ্রবাহ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ছিল ৭৪ হাজার ৫৭১ একর। এর ১০ বছর পর রাজউকেরই এক জরিপ বলছে, ড্যাপ নির্ধারিত বন্যাপ্রবাহ এলাকায় ৭২ হাজার ১৮১টি ছোট-বড় স্থাপনা রয়েছে। এর ৯৯ দশমিক ৯৮ শতাংশই অবৈধ।

১৯৮৫ সালে মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় মোট পুকুর ছিল দুই হাজারের মতো। তবে রাজধানীর সীমানা বাড়লেও বর্তমানে মাত্র ২৪১টি পুকুর আছে।

ড্যাপের কার্যকারিতা কাগজ-কলমে : পরিকল্পিত নগরায়ণের মাধ্যমে ঢাকাকে বাসযোগ্য করা হবে- এমন স্বপ্ন দেখিয়েই ২০১০ সালে ড্যাপ পাস করা হয়। এই সময়ে ড্যাপে দুই শতাধিক সংশোধনী আনা হলেও এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। ড্যাপ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ঢাকার জলাধার রক্ষিত হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ড্যাপের কার্যকারিতা কাগজ-কলমেই। শুধু ভবন তৈরির সময় ড্যাপ অনুযায়ী সংশ্নিষ্ট জমির ব্যবহার দেখা ছাড়া এর কোনো কার্যকারিতা আসলে নেই।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রক্রিয়াধীন ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে আগের ড্যাপে কিছু অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে সংশোধিত ড্যাপ (২০১৫-৩৫) প্রণয়নের কাজ রয়েছে শেষ পর্যায়ে। তিনি বলেন, আগের ড্যাপে কৃষিজমি কিংবা জলাশয় সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ ছিল না। এবার টিডিআর পলিসির (ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইটস) প্রস্তাব করা হয়েছে।

আইন লঙ্ঘন : প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। এই বিধান লঙ্ঘন করলে আইনের ৮ ও ১২ ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদ বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ অথবা উভয় দণ্ডে দি ত হবেন। একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, যে কোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ। কিন্তু আইন না মেনে জলাভূমি ভরাট চলছেই। শহর কিংবা গ্রামে একই চিত্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে শিথিল এবং অনেক ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগই হচ্ছে না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, মাস্টারপ্ল্যান এবং আইন ভেঙে জলাশয় ভরাট হচ্ছে। সরকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ করছে না। যার যেটা মন চায়, সে সেটা করছে। ড্যাপের আওতায় চিহ্নিত জলাশয়গুলো যারা ভরাট করেছে, তাদের শাস্তির মুখোমুখি করা হয়নি।

বিআইপির সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খানবলেন, ড্যাপের পরিকল্পনায় জলাভূমির বিষয় সুস্পষ্ট করা আছে। আইনগুলোও সুস্পষ্ট। কোনটি জলাধার এবং তা কীভাবে রক্ষা করা যাবে- সবকিছু বলা আছে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আইন কিংবা পরিকল্পনা থাকলেই হবে না, প্রয়োগ থাকতে হবে। প্রয়োগের দুর্বলতার কারণে জলাশয় দখল হচ্ছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, জেলা প্রশাসন, ওয়াসা কিংবা সিটি করপোরেশনসহ প্রতিটি আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যদি ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করত, তাহলে জলাশয় রক্ষা করা যেত। আইনের প্রয়োগ দুর্বল হওয়ার কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, যারা জলাশয় ভরাট কিংবা দখল করছে তারা প্রভাবশালী মহল। কেউ কেউ রাজনৈতিক মদদপুষ্ট। ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায়ের পরও জলাভূমিতে নির্মিত আবাসন উচ্ছেদ করা যায়নি; বরং নির্বিচারে অবকাঠামো উঠছে।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top