অনিয়ন্ত্রিত কয়লার ব্যবহার ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য ভয়ংকর
মোশতাক রাইহান, পরিবেশ টেলিভিশন
জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃসরকারি প্যানেলের (আইপিসিসি) বিশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। সে লক্ষ্য পূরণ করতে হলে কয়লাচালিত বেশির ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ২০৫০ সালের মধ্যে বন্ধ করা আবশ্যক। মোটকথা, অনিয়ন্ত্রিত কয়লার ব্যবহার খুব একটা সম্ভব নয় বরং ২০২০ সালের পর তা ক্রমান্বয়ে কমাতে হবে।
বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করলে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সব ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা জরুরি। এর ফলাফল হতে পারে, বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ জীবাশ্ম জ্বালানি অব্যবহূত থেকে যাওয়া। আর বেশি মাত্রায় গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণে কয়লা বেশ আগে থেকেই বিশেষ নজরে রয়েছে। এ কারণে গবেষক, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারকসহ অনেকেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। জার্মানি ২০৩৮ সালের মধ্যে সমস্ত কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার প্রস্তুতি নিয়েছে। সঙ্গে অন্যান্য দেশ যদি প্রত্যাশা অনুযায়ী তাদের জ্বালানি এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত নীতিমালা বাস্তবায়ন করে, ভবিষ্যতে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো মূল্যহীন সম্পদে পরিণত হবে অবশ্যম্ভাবী রূপে।
অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে 'ইকোফাই'-এর ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, জ্বালানি দক্ষ এবং কম দূষণকারী কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর নির্ভর করলে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বাড়তেই থাকবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত বিবেচনায় তা হবে ভয়ংকর। যদিও পৃথিবীর বার্ষিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশির দায় কয়লার, পৃথিবীর বেশ কিছু দেশের জ্বালানি নীতিতে এখনও কয়লাকে কিছুটা হলেও প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাদের মাঝে কিছু কিছু দেশের আর্থিক সংগতি থাকলেও কয়লা বর্জনে সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলা যায় নির্দি্বধায়।
এ কথা সত্য, কভিড-১৯ সৃষ্ট অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে এবং পর্যাপ্ত চাহিদা না থাকায় অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতায় পৌঁছানোয়, অনেক দেশ জ্বালানি নীতিমালা পুনর্মূল্যায়ন করছে এবং জ্বালানি হিসেবে কয়লার ভবিষ্যৎ নিয়েও ঈষৎ ভাবছে। তবে, কভিড-১৯ ছাড়া আর কী কারণেইবা নীতিনির্ধারকরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র্রের পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসবেন? শুধু কি প্যারিস জলবায়ু চুক্তির কারণে আমাদের পুরোনো কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্রমে বন্ধ করে দিতে হবে এবং নতুন করে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র যাতে আর না হয় সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে? ব্যাপারটা শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে অর্থনৈতিক বিভিন্নম্ন বিষয় জড়িত। গত কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি খাতে, বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যে আমূল পরিবর্তন এসেছে তাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এখন পৃথিবীর অনেক দেশেই ভর্তুকি বা প্রণোদনা ছাড়া কয়লা এবং অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে সাশ্রয়ী।
আরও লক্ষণীয়, আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংস্থার তথ্য মতে, ২০১৯ সালে স্থাপিত পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সবচেয়ে সস্তা কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এ সংস্থার প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, নতুন সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনেকগুলোকেই চলমান কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের তুলনায় পরিচালনা করা আর্থিকভাবে লাভজনক। আর পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল ৫০০ গিগাওয়াট ক্ষমতার সমপরিমাণ কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র যদি সৌর এবং উপকূলে স্থাপিত বায়ুচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়, প্রতি বছর প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সাশ্রয় সম্ভব। এতে করে বার্ষিক প্রায় ১.৮ গিগাটন কার্বন ডাই অপাইড নির্গমন কমানো যাবে, যা কিনা ২০১৯ সালে সমস্ত পৃথিবীতে যে গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন হয়েছে তার ৫ শতাংশ। কাজেই কয়লা প্রতিস্থাপনের সুবিধা নেহাত কম নয়। অন্যান্য যেসব সুবিধা কয়লা থেকে সরে আসতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে তার বেশির ভাগই বোঝা যায় স্থানীয়ভাবে। বায়ুর গুণগত মানে এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর কয়লার ক্ষতিকর প্রভাব সর্বজনবিদিত। এর সঙ্গে জীববৈচিত্র্যে কয়লার যে ক্ষতিকর ভূমিকা রয়েছে তার অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা হলে কয়লার গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংস্থার সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, জ্বালানি খাতে পৃথিবীতে ২০৫০ সালের মধ্যে নতুন ১৪ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে, যার ৮০ শতাংশ সুযোগ আসবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে। এমন অনেক সম্ভাবনার দিগন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্মোচন করতে পারে। অন্যদিকে, বিভিন্ন আলোচনায় আরেকটি দিক মাঝে মাঝেই উঠে আসে আর্থিক এবং প্রযুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে যে কয়লাকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে একটি দেশের পক্ষে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানির পুরো চাহিদা কি মেটানো সম্ভব? আর তা যদি হয়ও, কয়লা থেকে সরে এসে অন্য জ্বালানিতে পুরোপুরি নির্ভরশীল হতে কতদিন প্রয়োজন?
বাস্তবে, আমরা যেসব প্রযুক্তির কথা বলছি অর্থাৎ যেগুলো কয়লা প্রতিস্থাপন করবে, তা আজ সহজলভ্য এবং উন্নতির এমন পর্যায়ে রয়েছে যে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রয়োজনীয় প্রতিস্থাপন সম্ভব। ২০৫০ সালের মাঝেই এটা সম্ভব অর্থাৎ আমরা হাঁটতে পারি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ পথে। প্যারিস চুক্তির অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোকে সংশোধিত পূর্বনির্ধারিত অনুমিত অবদান (এনডিসি) জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত উইং ইউএনএফসিসিসি এই ডিসেম্বরেই জমা দেওয়ার কথা। জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি করে বিভিন্ন দেশের এনডিসিতে তার প্রতিফলন ঘটানোর যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির আর্থিক সুবিধা ও সহসুবিধা বিবেচনায় সামনের দিনগুলোতে জ্বালানি হিসেবে পৃথিবীব্যাপী কয়লার অবাধ ব্যবহারের খুব একটা সুযোগ নেই। তবে নিঃসংকোচে বলা যায়, কয়লাকে প্রতিস্থাপন কিংবা নতুন কয়লাভিত্তিক প্রকল্প থেকে সরে আসা বিভিন্ন দেশের টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে। নিজ নিজ দেশের জ্বালানি ও জলবায়ু নীতিমালায় সহসা এ কৌশলের প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
বিষয়: কয়লা জলবায়ু জ্বালানি বিদ্যুৎকেন্দ্র
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: