ঢাকা শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৬ই চৈত্র ১৪৩০


উপর-নিচ দুদিক থেকেই গলছে অ্যান্টার্কটিকার বরফ


প্রকাশিত:
৫ নভেম্বর ২০১৯ ০৮:৪৯

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৮:২১

ফাইল ছবি

পরিবেশ টিভি: অ্যান্টার্কটিকার হিমায়িত পাহাড় এবং জমাট বাধা সমভূমি যে পরিমান পানিকে বরফে পরিনত করে রেখেছে তা পুরো বিশ্বের সমুদ্রের উচ্চতা ২০০ ফিট পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। সৌভাগ্যবশত, এই মহাদেশের চার ভাগের তিন ভাগ অংশ ভাসমান বরফের টুকরো দিয়ে বেষ্টিত। বরফের টুকরোগুলো বিশাল গ্লেসিয়ারের অংশ যা পেছনের ভূমির সাথে আবদ্ধ বরফের দূর্গকে রক্ষায় দেয়ালের মত কাজ করে। কিন্তু ইদানিং বিজ্ঞানীরা নতুন সমস্যা আবিস্কার করছেন যা এই দেয়ালকে উপর এবং নিচ থেকে দূর্বল করে দিতে পারে।

পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার হিমায়িত রাজ্যের জমাট বরফের উপর গরমের সময় হাজার হাজার চমৎকার নীল হ্রদ তৈরি হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণার চেয়েও এই হ্রদের সংখ্যা অনেক বেশি। অপরদিকে, পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার দ্রুতগতিতে গলতে থাকা অংশে গরম পানির নদী বরফের বুক চিরে বয়ে যাচ্ছে, রেখে যাচ্ছে দূর্বল বরফ। যেহেতু বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েই চলেছে, উপরের দুটো প্রক্রিয়ার সম্মিলিত প্রভাবে অ্যান্টার্কটিকার সুরক্ষিত বরফ এবং দানবীয় গ্লেসিয়ার গলে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

বছরের বেশিরভাগ সময়ই পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের বরফ জমাট বাধা অবস্থায় থাকে। কিন্তু গরমকালে বরফের উপরিভাগ গলে যায় যার ফলে টোপাজ নীল রঙের হ্রদ তৈরি হয়। চমৎকার এই হ্রদগুলো দেখতে খুবই সুন্দর হলেও এরা বরফের জন্য দুঃসংবাদ। তাদের গাঢ় রঙ সূর্যের আলো অধিক পরিমানে আকর্ষণ করে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার ফলে বরফ আরো বেশি গলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই হ্রদের পানি বরফের নিচেও চলে যায়, যার ফলে বরফের টুকরোয় ফাটল ধরে এবং একসময় পুরোপুরি গলে যায়।

বিজ্ঞানীরা গত এক দশক ধরে অ্যান্টার্কটিকা এবং গ্রিনল্যান্ডের গলিত বরফের হ্রদ নিয়ে গবেষণা করছেন। এই অঞ্চলগুলোর তাপমাত্রা খুব দ্রুতগতিতে বাড়ছে। সম্প্রতি একদল গবেষক সবচেয় ঠান্ডা এবং সবচেয়ে বেশি স্থায়ী বরফের রাজ্য পূর্ব অ্যান্টার্কটিকায় তাদের প্রথম সিস্টেমিক সার্ভে সম্পন্ন করেছেন। সার্ভে শেষে তারা তাদের প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি সংখ্যক হ্রদ পেয়েছেন। জানুয়ারি ২০১৭ এর স্যাটেলাইট ডাটা থেকে গবেষকরা পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার উপকূলে ৬৫,০০০ হ্রদ চিহ্নিত করেছেন। তবে হ্রদের সংখ্যার চেয়েও বেশি চিন্তার বিষয় হচ্ছে অনেকগুলো হ্রদের পানি বরফের নিচে পর্যন্ত চলে গেছে যার ফলে বরফে ফাটল ধরে পুরো গ্লেসিয়ার ভেঙে পরার সম্ভাবনা রয়েছে।

গবেষণায় শুধুমাত্র একটি মরসুমের ডাটা নেয়া হয়েছে। গত ২০১৬ এবং ২০১৭ এর প্রথমদিকের স্যাটেলাইট ডাটা থেকে দেখা যায়, অস্বাভাবিক আবহাওয়ার কারণে অ্যান্টার্কটিকার উপকূলের বরফ ভাংছে। সামনের মরশুমগুলোতেও এই গবেষণা চালিয়ে যাবেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু ২০১৭ এর ডাটা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, গরমের সময়ে পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার বরফের স্তরে ঝুকির মাত্রা অনেক বেড়ে যায়।

পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার হ্রদ যেমন বিজ্ঞানীদের মনে উদ্বেগ তৈরি করছে তেমনি পশ্চিমেও অদেখা এক শক্তি বরফকে নিচ থেকে আক্রমণ করছে। গভীর থেকে গরম পানির ফোয়ারা বের হচ্ছে যা বরফকে নিচ থেকে খেয়ে ফেলছে। বিজ্ঞানীরা এই গরম পানির ফোয়ারার নাম দিয়েছেন উল্টো নদী (Upside-down river)।

ক্যারেন এলি, উস্টার কলেজের একজন গ্লাসিওলজিস্ট, কয়েক বছর আগে এই উল্টো নদীর উপরে একটি গবেষণা করেছেন। স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি থেকে বরফের উপরের তল পরীক্ষা করে তিনি বুঝতে পারেন যে, এই নদীগুলোর মধ্যে কিছু কিছু অনেক বড়, প্রায় ৩ মাইল চওড়া, ১০ মাইল লম্বা এবং শত ফিট গভীর। তিনি লক্ষ করেন, এই নদীগুলো বেশির ভাগই বরফের বিভক্ত প্রান্তে তৈরি হয় যেখানে বরফ অপেক্ষাকৃত দূর্বল থাকে।

সাম্প্রতিক গবেষণায় এলি এবং তার সহযোগী গবেষকগণ স্যাটেলাইটের ছবি থেকে এর কারণ বের করার চেষ্টা করেন। তারা বলেন, গরম পানির এই নদীগুলো তৈরি হয় মূল ভূমিতে। ভুমি থেকে বরফ সমুদ্রের দিকে যেতে যেতে কিনারায় এসে পাতলা হয়ে যায়। এই পাতলা বরফ যখন সমুদ্রে পৌঁছে তখন নদী এই পাতলা বরফের নিচ দিয়ে বয়ে চলে। গরম পানি বরফের ভেতরে টানেল তৈরি করে উল্টো নদীর জন্ম দেয়।

এই উল্টো নদী বরফ দ্রুত গলার জন্য কতখানি দায়ী তা এতদিন কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারছিল না। কিন্তু এলির গবেষণার পরে জানা যায় যে এই নদীর কারণে গ্লেসিয়ারের ভিত থেকে প্রায় ৩০ ফিট পর্যন্ত বরফ এক বছরে গলে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই গরম পানির তাপমাত্রা যদি সামান্য পরিমানও বৃদ্ধি পায় তাহলে বরফের স্তর আরো দ্রুত পাতলা হয়ে যাবে।

বরফের উপরিতলের হ্রদ এবং নিচের গরম নদী, এই দুইয়ের সম্মিলিত প্রভাবে অ্যান্টার্কটিকার বরফ খুব দ্রুতগতিতে গলছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সামনে হ্রদের সংখ্যা আরো বাড়বে। বরফের তলের গরম পানির প্রভাবে হ্রদের বরফ আরো দ্রুত গলবে। অ্যান্টার্কটিকার দ্রুত গলে যাওয়া বরফের ফলে মেরু অঞ্চলে তাপমাত্রার বিরাট তারতম্যের সৃষ্টি হবে যা পুরো পৃথিবীর পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য নষ্ট করবে।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top