কাব্য কবিতায় হেমন্তকাল
ঋতুচক্রের পরিক্রমায় বঙ্গঋতুনাট্যে শরতের পরে শূন্যতা, রিক্ততা ও বিষণ প্রকৃতির মেদুরতাহীনতায় আবির্ভূত হয় হেমন্ত ঋতু। শরৎ প্রকৃতির বহু বর্ণিল ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্যের স্নিগ্ধতার আবেশ মানবমনে শিহরণ তোলে না, শিহরণ তোলে হিমসমীরণে অদূরবর্তী তুষরের আগমনীবার্তা। হেমন্ত ঋতুর প্রারম্ভে ব্যাপ্তচরাচরে বিস্তীর্ণ নয়নসম্মুখে কেবলই বৈরাগ্যের বিষন্নতা, হতাশা ও রিক্ততার অশুভ ধ্বনি। কিন্তু পক্ষকাল অন্তে হেমন্ত লক্ষ্মীর শুভাশিসে রাশি রাশি ভারা ভারা কনক আভাময় পাকা ধান মাঠে মাঠে শোভা পেতে থাকে। রৌদ্রখর তপ্তদাহ উপেক্ষা করে যে কৃষক ফলিয়েছে সোনা ধান ক্ষেতের আলে দাঁড়িয়ে তার অন্তঃস্তল থেকে বেরিয়ে আসে প্রাপ্তির নির্মল হাসি। প্রকৃতির এই যে কল্যাণময়ী রূপশ্রী, অকাতরে অন্নের সংস্থান বঙ্গবাসীকে প্রাচুর্যময়ী হেমন্ত লক্ষ্মীর অকৃপণ করুণারই নামান্তর।
সাহিত্যে ষড়ঋতুর প্রভাব সংবেদনশীল কবিচিত্তের সন্নিধানে কাব্যিক সুষমাম-িত চিত্রে উপস্থাপিত হয়েছে বহুকাল থেকেই। কবিচিত্রের রূপ রসে ঋতুচক্রের ভিন্নভিন্ন প্রকৃতি বাঙ্ময় হয়ে উঠে এসেছে তাঁদের শিল্প সাহিত্যে। মানুষ প্রকৃতির সন্তান তাই প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্য রচয়িতা কবিেেদর পক্ষে তো নয়ই। তাই তাঁদের রচনায় প্রকৃতি একটি বড় অনুষঙ্গ এবং কাব্য সমৃদ্ধির এক সোনালি উদ্ভাসও বটে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতের প্রভাব দীর্ঘ হলেও হেমন্তের প্রভাব একেবারেই নিস্প্রভ নয়। হেমন্ত প্রথমত ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি, নির্মল পরিতৃপ্তি ও আসন্ন শীত ঋতুর আগমনী বার্তাবহ এবং দিনান্তে তৃণলতার নিটোল নিশার শিশির।
বাংলা সাহিত্যে হেমন্ত স্বল্প স্থায়িত্ব হলেও একেবারে তার প্রভাব দুর্লক্ষ্য নয়। বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক তাঁদের সুনিপুণ হাতের জাদু স্পর্শে শৈল্পিক সৌকর্যে হেমন্ত অনবদ্য বাণীমূর্তি রূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। সাহিত্যের প্রাচীন যুগে বৌদ্ধ সহজিয়াগণ রচিত চর্যাপদে কোন ঋতুরই উপস্থিতি নেই। তবে মধ্যযুগের কবি কংকন মুকুন্দরাম চক্রবর্ত রচিত ‘কালকেতু’ উপাখ্যানে হেমন্তের সামান্য নমুনা পরিদৃষ্ট হয়। কবির ভাষায়:
‘কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ
যগজনে করে শীত নিবারণ বাস’
মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলিতে হেমন্তের নতুন ধান্যে কৃষকের ঘরে ঘরে সুখের আবেশ ছড়ায়। এ সময়ে তারা পরম তৃপ্তিতে সুখস্মৃতি নিয়ে আনন্দ বিলাসে মেতে ওঠে। বৈষ্ণব পদকর্তা লোচনদাসের পদে তার সমর্থন প্রকটিত হয়েছে।
অগ্রাণে নোতুন ধান্য বিলাসে।
সর্বসুখ ঘরে প্রভু কি কাজ সন্ন্যাসে ॥
পাটনেত ফোটে ভোটে শয়ন কম্বলে।
সুখে নিদ্রা যাও তুমি আমি পদ তলে ॥
বৈষ্ণব পদকর্তাগণের মধ্যে গোবিন্দদাস বিশেষভাবে উলেখযোগ্য। তাঁর রচিত পদে তৎকালীন গ্রামীণ সমাজ জীবনের নিখুঁত চিত্র ফুটে উঠেছে। অঘ্রাণে কৃষাণ-কৃষাণীর সমৃদ্ধি ও সুখের সময়ে কুলবধূরা স্বামীগৃহ থেকে পিতৃগৃহে নায়রে গমন করে। তার রচিত পদে উলিখিত হয়েছে:
আঘাণ মাস রাস রস সায়র
নায়র মাথুরা গেল।
পুর রঙ্গিনীগণ পুরল মনোরথ
বৃন্দাবন বন ভেল ॥
বাংলাদেশ গ্রামভিত্তিক কৃষি প্রধান দেশ তাই কৃষক, কৃষিপণ্য, কৃষকের জীবনাচরণ আধুনিক বাংলা কাব্যের একটি বড় অনুষঙ্গ এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ কারণে এ দেশের প্রায় সকল কবিই সাহিত্যিকের রচনায় কোন না কোনভাবে হেমন্ত ঋতুর প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে। বিশেষত বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), হেমন্ত ঋতু নিয়ে অজস্র কবিতা ও গান রচনা করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), জসীম উদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬), সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৮৯৯), সুধীন দত্ত (১৯০১-১৯৬০), বিষ্ণুদে (১৯০৯-৮২), শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) আল মাহমুদ (১৯৩৬), শক্তি চট্টাপাধ্যায়, অনীক মাহমুদ (জন্ম. ১৯৫৮) প্রমুখের কাব্যে হেমন্ত ঋতু অসাধারণ চিত্রকল্পে পাঠক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
নিসর্গ প্রকৃতি, ঋতুচক্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মদর্শন ও ভাববাদী চিন্তা চেতনায় অন্তর্লোকে পরমাত্মার স্পর্শে মূর্ত হয়ে উঠেছে নিরালোকের ভাব ও ব্যঞ্জনাময় উপস্থিতিতে। তাঁর অসংখ্য গান ও কবিতায় হৈমন্তিক বিশিষ্টতা ধরা পড়ে। তাঁর কাছে হেমন্ত নিঃশব্দ গতিহীন স্তবতা এবং অবারিত শান্তির প্রতীক।
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে
জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার
স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’
[“নৈবেদ্য” ]
কবিগুরুর অসংখ্য কবিতা ও গানে হেমন্ত ঋতুর প্রসঙ্গে এসেছে বহুবার। হেমন্তে কোন বসন্তেরই রাণী/পূর্ণশশী ওই যে দিন আনি। বকুল ডালের আগায়। জ্যোৎস্না যেন ফুলের স্বপন লাগায়।’ আবার ‘হিমের রাতে ওই গগনের দীপ গুলিরে। হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে।’ প্রভৃতি গানে প্রকৃতি পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় হেমন্তের মেঘমুক্ত গগনে পূর্ণশশীর আলোকছটায় কীভাবে বিশ্বময় উদ্ভাসিত করে তোলো তার চিত্রকল্প ফুটে উঠেছে।
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডরষষরধস ডড়ৎফংড়িৎঃয এবং জীবনান্দ দাসের মতো অন্তরাত্মার সম্পৃক্ততায় জীবন্ত উদ্ভাসন পরিলক্ষিত হয় না। তাঁর কবিতায় হেমন্ত শিশির ভেজা হিমেল হাওয়ার শিশির অনুভূতি এবং তীর্যক কাঁচা রোদের উষ্ণ পরশ।
‘হেমন্তের ঐ শিশির নাওয়া হিমেল হাওয়া
সেই নাচনে উঠল মেতে।
টইটুম্বুর ঝিলের জলে
ফাঁটা রোদের মানিক জ্বলে
চন্দ্র ঘুমায় গগন তলে
সাদা মেঘের আঁচল পেতে।’
তাঁর ‘অঘ্রাণের সওগাত’ কবিতার হেমন্তের আবির্ভাব ঘটে ধরণীতে আশীর্বাদের বার্তা নিয়ে। এ সময়ে গ্রাম বাংলা নতুন ধানের নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে। বাড়িতে বাড়িতে চলে ফিরনি, পায়েস ও পিঠা তৈরীর ধুম।
‘ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এল কি ধরণীর সওগাত।
নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হল মাৎ।
গিন্নি পাগল চালের ফিরনি
তশতরী ভরে নবীনা গিন্নী
হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীদের খুশিতে কাঁপিছে হাত।
শিরনি বাঁধেন বড় বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেস্মাত।
হেমন্ত প্রকৃতিতে গ্রামীণ জীবনের নিখুঁত চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে পল্লিকবি খ্যাত জসীম উদদীনের (১৯০৩-১৯৭৬) কবিতায়। এ সময়ে মাঠে মাঠে পড়ে থাকে হলুদ পাকা ধান। কৃষাণ-কৃষাণীর ব্যস্ততা পাকা ধান ঘরে তোলার । পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ ছড়ায় চারদিক। এ সময়ে বৃক্ষশাখা থেকে ফুল-পাতা ঝরে পড়ে। কিছুদিন চলে প্রকৃতিতে শূন্যতা ও রিক্ততার প্রকাশ।
‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,
সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।
ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু
কলমি লতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু।’
[“সুখের বাসর” ‘নক্সীকাথার মাঠ’]
বাংলার প্রকৃতিতে প্রাচুর্যময়ী হেমন্ত যেন কল্যাণময়ী নারীর অকৃত্রিম শুভশ্রীর নিরাভরণ উপস্থিতি; আত্মমগ্ন কবি চিত্তের অনুধ্যানের অনুষঙ্গ। হেমন্তের রূপ লাবণ্যে নিমগ্ন কবি জীবনান্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) অজস্র কবিতায় ধূমল কুয়াসাচ্ছন্ন হেমন্ত প্রকৃতি অন্তরঙ্গ অনুভবের সংশ্লিষ্টতায় অপূর্ব বাণীমূর্তি রূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। হেমন্ত তাঁর প্রিয় ঋতু। অপূর্ব কাব্যিক সুষমায় হেমন্ত তাঁর তুলির আঁচড়ে বাঙময় রূপে ধরা দিয়েছে। আর কোন কবির কাব্যে হেমন্ত তাঁর মতো রূপক, উপমা অলংকার, নব নব শব্দের বিনুনিতে এতো অনবদ্য প্রকাশ চোখে পড়ে না। ‘হেমন্তের কবি জীবনান্দ দাশ’ প্রবন্ধে নরেশ গুপ্ত লিখেছেন, “জীবনানন্দের কবিতা পড়তে পড়তে অজান্তে কখন আমরা সেই রূপসী হেমন্তের প্রেমে পড়ে যাই। ভেবে অবাক লাগে, কৃষির সোনার কৌটোতে আমাদের প্রাণের ভ্রমরটি যদিও ভরে রাখা আছে তাহলেও ফলন্ত ধানের ঋতু হেমন্তের গাঁথা বাংলা কবিতায় একরকম ব্যতিক্রম বললেই চলে। শুধু কি দৃশ্যের? গন্ধের, শস্যের, আলস্য পূর্ণতা-বিষাদের করুণতামাখা লাবণ্যময়ী ঋতু হেমন্ত বাংলার কাব্য বর্ষার স্তুতিতে, বসন্তের বন্দনায় মুখর এবং সে দুটি বিখ্যাত ঋতুই বিখ্যাত আরো অনেক কিছুর মতো জীবনানন্দের কবিতায় অনুপস্থিত। হেমন্তের গভীর গম্ভীর রূপ কীটস্ এরও প্রাণ ভুলিয়েছিল। শেষ পর্বে জীবনানন্দের কাব্যে যখন জনমান্তর ঘটছে, হেমন্ত তখনো তাঁর উপকরণ হয়েছিল, তার ব্যবহার যদিও তখন ভিন্ন। হেমন্ত প্রথমত শস্যেও, তৃপ্তির, বিরতির ঋতু।” হেমন্ত তাঁর চোখে কেবল রূপসজ্জা ও সৌন্দর্যের জৌলুস মাত্র নয়; হেমন্ত তাঁর কাছে প্রেম বিরহ মিলন ও সৃষ্টির এক অপার বিস্ময়। কবি হেমন্তকে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন বিকেলের নরম হলুদ রঙের বর্ণবৈভবহীনতা এবং বিরাণ শূন্য প্রান্তরের বিবর্ণতা।
‘আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি-বিকেলের এই রং-রঙের শূন্যতা
রোদের নরম রোম-ঢালু মাঠ-বিবর্ণ বাদামি পাখি-হলুদ বিচালি
পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসে কুড়ানির মুখে তাই নাই কোনো কথা,
ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে জীবনেরে জেনেছে সে কুয়াশায় খালি
তাই তার ঘুম পায়-ক্ষেত ছেড়ে দিয়ে যাবে এখনি সে ক্ষেতের ভিতর
এখনি সে নেই যেন ঝড় পড়ে অঘ্রাণের এই শেষ বিষণœ সোনালি।’
[“অঘ্রাণ” ‘জীবনানন্দের অপ্রকাশিত কবিতা’]
‘নির্জন স্বাক্ষর, ‘পেঁচা, ‘ধানকাটা হয়ে গেছে’, ‘অঘ্রাণ প্রান্তরে’ ‘হেমন্ত রাতে’ ‘হেমন্ত’ হেমন্ত কুয়াশায়, ‘হেমন্তের নদীর পারে’ অঘ্রাণ, গোধূলি সন্ধির নৃত্য’ প্রকৃতি কবিতায় হেমন্ত ঋতু অনবদ্য শিল্প সুষমায় জীবন চিত্রকল্পের চোখের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে।
গ্রাম বাংলার অনবদ্য রূপ সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ কবি সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯) পল্লি প্রকৃতির সহজ সরল ও স্বাভাবিক রূপ তাঁর কাব্যে উপজীব্য হয়ে উঠেছে। গভীর মমতায় ও ভালোবাসায় প্রকৃতি তাঁর অন্তরঙ্গ অনুভবের সংশ্লিষ্টতায় অপূর্ব সৌন্দর্যে আবিভূত হয়েছে পল্লী-বাংলার পরতে পরতে।
‘হেমন্তের কবি আমি, হিমাচ্ছন্ন ধূসর সন্ধ্যায়
গৈরিক উত্তরীয় টানি মিশাইয়া রহি কুয়াশায়।’
[“মন ও জীবন”]
আবার কখনো তিনি হেমন্তকে চিঠি লিখে বাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতিতে আবিভূত হওয়ার আহ্বান ও জানিয়েছেন।
‘সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?’
হেমন্তের আগমনে শিশির সন্ধ্যায় শিরশির হিমেল অনুভূতি আসন্ন শীতের বার্তা বয়ে আনে। শস্যহীন রিক্ত মাঠ, বৃক্ষ শাখা থেকে হলুদাভাব চ্যুত পত্রের স্তুপ। এ সময়ে বিরাণ মরুভূমির মতো চারিদিকে নি®প্রভ জীবনের নৈরাশ্য ধ্বনি উত্থিত হতে থাকে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের (১৯০১-১৯৬০) কবিতায় প্রকৃতির এই রিক্ততা ও শূন্যতার চিত্রকল্পে হেমন্তের শাশ্বত নীরব ও বিষণœতার চিত্রই ফুটে ওঠে।
‘ধূমায়িত রিক্ত মাঠ, গিরিতট হেমন্ত লোহিত
তরুণ তরুণী শূন্য বনবীথি চ্যুত পত্রে ঢাকা,
শৈবালিত স্তব্ধ হ্রদ, নিশাক্রান্ত বিষণœ বলাকা
ম্লান চেতনারে মোর আকস্মাৎ করেছে মোহিত ॥
[“হৈমন্তী” ‘অর্কেষ্ট্রা’]
হেমন্ত ঋতু যে বিষণœতা রিক্ততা ও শূন্যতার এই বোধ আধুনিক কাব্যে পল্লীবত হয়ে শাখা মেলেছে জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)ও বুদ্ধদেব বসুর (১৯০৮-১৯৭৪) কবিতার পঙ্ক্তিতে। হেমন্ত বুদ্ধদেব বসুর তীক্ষè চৈতন্যেকে আনন্দে উদ্বেলিত করে না, তাঁর বিষণœ মনে হেমন্ত আর দোলা দিয়ে ওঠে না।
‘পউষে ফাল্গুন গাঁথা কান্না-হাসি দোলানো অন্যায়
আমাকে বেঁধে না আর, বড়ো জোর রাত, পিত্ত, শ্লেষ্মার সংবিৎ
এঁকে যায় যায় সামান্য গণিত চিহ্নে পঞ্জিকার পালা’।
[“ঋতুর উত্তরে” ‘যে আঁধার আলের অধিক’]
পল্লী বাংলার লোকায়িত জীবন ও তার শ্যামল রূপ ঐশ্বর্য আল মাহমুদের (জ.১৯৩৬) কবিতায় ফুটে উঠেছে। তাঁর প্রকৃতি কখন কখন দেহজ কামনা বাসনায় অপূর্ব নারী মূর্তি রূপে আকর্ষণ করেছে সান্নিধ্য পাওয়ার আকাক্সক্ষায়। তাঁর কব্যে প্রেম প্রকৃতি সৌন্দর্য ও নারী অভিন্ন সত্তার একাকার হয়ে মিশে আছে।
‘আজ এই হেমন্তের জলজ বাতাসে
আমার হৃদয় মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে
রমণীর প্রেম আর লবণসৌরভে
আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর
বসায় মার্চের দাগ, লাল কালো
কট ও কষায়।’
[“অঘ্রাণ’]
হেমন্তের আগমনে গ্রামীণ পল্লীজীবনে কৃষাণ কৃষাণীর মুখশ্রীতে আনন্দের ঝিলিক খেলে যায়। নতুন স্বপ্নে বিভোর এ শ্রেণির মানুষেরা অনাগত দিনগুলোর সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের নিমিত্তে শস্যভা-ার পরিপূর্ণ করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ব্রাত্যধারার মানুষের সঙ্গে হেমন্ত প্রকৃতির সাযুর্যে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় গ্রামীণ প্রকৃতির চিরাচরিত স্বাভাবিক রূপটিই উন্মোচিত করেছেন।
‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান ঘুরতে দেখেছি অনেক।
তাদের হলুদ ঝুলি ভরে গিয়েছিল ঘাসে আবিল ভেড়ার পেটের মতন
কতকালের পুরোনো নতুন চিঠি কুড়িয়ে পেয়েছে
তাই হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যানগুলি
আমি দেখেছি কেবল অনবরত ওরা খুঁটে চলেছে
বকের মতো নিভৃত মাছ।’
[“হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান”]
মাঠে মাঠে ছড়ানো সোনালি ধানের প্রাচুর্য হেমন্ত লক্ষ্মীর সুপ্রসন্ন দৃষ্টির প্রকাশ হলেও মাঝে মাঝে কৃষাণ কৃষাণী সর্বস্বান্তও হয়ে পড়ে। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, বন্যায় ভেসে যায় ফসলের মাঠে আবার কখনো মহাজনী শোষণে নিঃস্ব হতে থাকে কৃষকের জীবন স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে কৃষকের জীবন, অনিকেত দুঃসহ বেদনা ভার তাদের দিশেহারা করে তোলে। কবি অনীক মাহমুদেও (জ.১৯৫৮) কবিতায় কৃষকদের সে মর্মন্তুদ বেদনা বিধূর চিত্র ফুটে ওঠে।
‘আবার ফেরাও চোখ মুখ্যুসুখ্যু জনপদ বস্তির উঠোনে,
হেমন্তের রুপোলি শিশির এসে ধুয়ে গেছে পা-ুরিত ঘাসের গালিচা,
এখানে পড়েনি তবু লক্ষ্মীর করুণা, দ্রৌপদীর পদপাত,
জলমগ্ন ধানক্ষেতে বন্যার অশনি থাবা শেষ হয়ে গেছে,
খুশির চিবুক ছুঁয়ে এখনো আসেনি কোনো আগন্তুক
নবান্নের কাকভোরে উপদ্রুত হাতে শূন্য পাত্র কাঁপে...
খরাদগ্ধ ফসলের ঘ্রাণ উঠে গেছে মহাজনী মজুত খানায়।’
[“হেমন্তের প্রতি” ‘এক লব্যের ভবিতব্য’]
হেমন্ত প্রকৃতির বৈচিত্র্যে এদেশের অসংখ্য কবি সাহিত্যিক বিস্তর মুগ্ধচিত্ত না হলেও অনেকেই এ প্রকৃতি নিয়ে কবিতা রচনার প্রয়াস পেয়েছেন। সৃজনশীল কবি হৃদয় এ বিষণœ, উদাসীন প্রকৃতিকে স্নিগ্ধ মধুর কাব্যিক উপমায় হেমন্তকে তুলে ধরেছেন মমতাময়ী নারীর সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতাকে । হেমন্ত লক্ষ্মী এ সময় ধরাধামে তার প্রসন্ন দৃষ্টির মায়ায় কৃষকের গোলা ভরে দেয় পরদুঃখ হরনেচ্ছায় শান্তির পরশে। আধুনিককালের প্রায় সকল কবিরই রচনাতে কোন না কোনভাবে হেমন্ত ঋতুর প্রসঙ্গ বিদ্যমান রয়েছে। উপমা রূপক উৎপেক্ষা ও অলংকারে হেমন্ত ঋতু কবি হৃদয়ের সংশ্লিষ্টতায় অনবদ্য ও নান্দনিকতায় আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্যে অনন্য বৈশিষ্ট্যে উপস্থাপিত হয়েছে -একথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
সূত্র: ইনকিলাব
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: