ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


আবহমান বাংলায় ষড় ঋতুর পরিক্রমায় এলো হেমন্ত


প্রকাশিত:
২০ অক্টোবর ২০২১ ০৬:০৫

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ১৬:৪৬

মুক্তো বিন্দুর মতো শিশির জমতে শুরু করেছে ঘাসের ডগায়, ধানের শিষের প’রে। আদিগন্ত মাঠ জুড়ে এখন ধানের প্রাচুর্য। হলুদে-সবুজে একাকার অপরূপ প্রকৃতি। চারদিকে ধূসর আবহ ঘিরে রাখছে। শেষ বিকালে কুয়াশার আবছা চাদর প্রকৃতিকে ঢেকে শিশিরের শব্দের মতো নামছে সন্ধ্যা। ‘হেমন্ত তার শিশির ভেজা/ আঁচল তলে শিউলি বোঁটায়, চুপে চুপে রং মাখাল/ আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়/...।’ সবুজ পাতার খামের ভেতর/ হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন্ পাথারের ওপার থেকে/ আনল ডেকে হেমন্তকে ..আজ পয়লা কার্তিক। আবহমান বাংলায় ষড় ঋতুর পরিক্রমায় এলো হেমন্ত।

শরত্কালের পর কার্তিক-অগ্রহায়ণ মিলে হেমন্ত। নতুন ঋতুর আগমনে রূপ বদলায় প্রকৃতি। হেমন্তকে বলা হয় শীতের বাহন। প্রকৃতিতে অনুভূত হচ্ছে ঈষত্ শীতার্ত আমেজ। দিনে তাতানো রোদ্দুর থাকলেও শেষ রাতে কুয়াশা ঘিরে রাখছে উত্তরের অনেক জনপদ। গ্রামীণ জনপদে এখন হিম হিম অনুভব। খণ্ড খণ্ড মেঘ সরে গিয়ে উদোম হয়েছে বিশাল নীল আকাশ। আনন্দধারায় ভাসছে কৃষকের মন-প্রাণ। কারণ এই হেমন্তে বাড়ির উঠোন ভরে উঠবে নতুন ধানের ম-ম গন্ধে। বাঙালির প্রধান অন্ন, আমন ধান কাটার মাহেন্দ্র সময় হেমন্তের শেষ ভাগে। আশ্চর্য ঋতু হেমন্তে প্রকৃতির বিচিত্র রূপের বর্ণনা আর স্তুতিতে মগ্ন হয়েছেন কবি-সাহিত্যিকেরা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়—‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা-/ হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা।/ সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে,/ কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা।/ ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।/ দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে...।


গতকাল সন্ধ্যায় অস্ত যাওয়া আশ্বিনের শেষ সূর্যটার সঙ্গে নগরের তপ্ত শ্বাসও অস্ত যাওয়ার কথা, কিন্তু জলবায়ুর যে নিত্য বদল, তাতে এই গরম আরো কদিন থাকবে। সাগরে ঘনিয়েছে লঘুচাপ। বর্ষাবাদল হতে পারে। অগ্রহায়ণে ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে জেঁকে বসতে শুরু করবে শীত। হেমন্তকে সবচেয়ে চেনা যায় ভোরের শিশিরে। খুব ভোরে শীতল বাতাসে। সবুজ পাতার গায়ে জমে থাকা শিশিরবিন্দু অপার্থিব দৃশ্যমালা রচনা করে। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, ‘লিপি কাছে রেখে ধূসর দ্বীপের কাছে আমি/ নিস্তব্ধ ছিলাম ব’সে;/ শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;/ নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি/ উড়ে গেলো কুয়াশায়,-কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো...।’

কবি জীবনানন্দ দাশ তার ‘অবসরের গান’ কবিতায় হেমন্তের অপরূপ চিত্র এঁকেছেন—‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপর মাথা রেখে/ অলস গেঁয়োর মতো এইখানে-কার্তিকের ক্ষেতে;/ মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার/ চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ/ তাহার আস্বাদ পেয়ে পেকে ওঠে ধান...। হেমন্ত জীবন ও প্রকৃতিতে এক আশ্চর্য সময় হয়ে ওঠে। বর্ষার পরে এই সময়ে বৃক্ষরাজি থাকে সবুজে ভরা। ভরা থাকে খালবিল নদীনালা। বিল জুড়ে সাদা-লাল শাপলা আর পদ্ম ফুলের সমারোহ। এই হেমন্তের দুই রূপ প্রতিভাত হয়। প্রথম মাসটির এক রূপ। পরেরটির অন্য। একসময় হেমন্তের প্রথম মাসটি ছিল অনটনের। ফসল হতো না। বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিত। সারা বছরের জন্য জমিয়ে রাখা চাল ফুরিয়ে যেত এই সময়ে এসে। ধানের গোলা শূন্য হয়ে যেত। কার্তিকের দুর্নাম করে তাই বলা হতো ‘মরা কার্তিক’।


কবিগুরুর কবিতায়ও আভাস পাওয়া যায় মন্দাক্রান্ত কার্তিকের। তিনি লিখেছেন, ‘শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,/কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে।’ অগ্রহায়ণে আবার উলটো চিত্র। নবান্নের এই মাস সমৃদ্ধির। এ সময় মাঠের সোনালি ফসল কাটা শুরু হয়। দেখতে দেখতে গোলা ভরে ওঠে কৃষকের। হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানে ভরে ওঠে। কৃষকবধূ ধান শুকাতে ব্যস্ত। প্রতি ঘর থেকে আসে ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ। দিনে দিনে বদলাচ্ছে সেই হিসাব-নিকাশ। এখন আগের সেই অভাব নেই। শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। আয়-রোজগারও বেশ। পাশাপাশি এখন কার্তিক মাসেই রিষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শিষ। পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। অগ্রহায়ণ পুরোটা জুড়ে সারা বাংলায় চলবে নবান্ন উত্সব। বাঙালির প্রধান ও প্রাচীনতম উত্সবগুলোর একটি নবান্ন। কৃষিভিত্তিক সভ্যতার পুরোভাগে থাকা এই নবান্ন উত্সব অনাদিকাল থেকে বাঙালির জীবন অধিকার করে আছে।


পুনর্জন্মে বিশ্বাসী প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের কণ্ঠে পুনর্বার ফিরে আসার আকুতি ধ্বনিত হয়েছে, ‘আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয় হয়তো শঙ্খচিল শালিখের বেশে;/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’। আবহাওয়াবিদদের মতে, এখন থেকে যত দিন যাবে, ততই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমতে থাকবে। পার্থক্য যত কমবে, তত শীত বাড়তে থাকবে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এখন প্রকৃতি যেন আর নিয়ম মানছে না। কেমন খামখেয়ালী হয়ে উঠেছে।

সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক


বিষয়:



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top