কোভিড-১৯ এবং জলবায়ু পরিবর্তন
একদিকে জলবায়ু পরিবর্তন; অন্যদিকে কোভিড-১৯-দুটিই এখন শিশু শিক্ষায় অভিশাপ হয়ে আছে। মার্চ ২০২০-এর আগের পৃথিবীর শিশুরা এখন আর স্কুলের ব্যস্ততা নিয়ে মেতে নেই; তাদের আহ্বান করে না পড়ার টেবিল।
নেই বিনোদন কিংবা স্বাধীনতা, যেন তাদের জীবনে সবচেয়ে বিপর্যয়কর অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছে। কবে শিশুদের জন্য পৃথিবীতে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ফিরে আসবে, তা এখন আকাশকুসুম কল্পনা। অপরদিকে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অতি খরা, অনাবৃষ্টি ও নদীভাঙনের কারণে বাংলাদেশ আজ হুমকির মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনে স্থলসীমান্ত যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমন মানবসম্পদও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
এক্ষেত্রে বয়স্কদের তুলনায় শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উপকূলীয় এলাকায় যেসব রোগব্যাধি দেখা দিচ্ছে, তার প্রায় ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। একইসঙ্গে শিশুদের মধ্যে পানি ও বায়ুবাহিত রোগ, অপুষ্টি, দুর্যোগকালীন মৃত্যু, শারীরিক ও মানসিক আঘাত কিংবা ধকলের হারও বাড়ছে।
ঘন ঘন বন্যার কারণেও দীর্ঘ মেয়াদে শিশুদের স্কুল বন্ধ থাকছে। এতে করে অনেক শিশুর স্কুলে যাওয়া একেবারেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে অনেকেই শিশুশ্রমে জড়িত হতে বাধ্য হচ্ছে। এক্ষেত্রে মেয়েশিশুদের অবস্থা আরও করুণ। মেয়েশিশুর নিরাপত্তার কথা ভেবে অভিভাবকরা তার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বরের বয়স কত-তা নিয়ে আর ভাবা হয় না।
বস্তুত পরিবারের অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যাশিশুটিকে একজন পুরুষের হাতে তুলে দেওয়াটাই নিরাপদ বলে মনে করা হয়। দুঃখজনক হলো, বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতে ওই ‘শিশু বউয়ের’ শরীর ভেঙে ভেঙে পড়ে। হয়তো বছর না ঘুরতেই তার গর্ভে জন্ম নেয় অপুষ্টি শিশু। এ ধারাবাহিকতায় অপুষ্টি আর অল্পবয়সে মা হওয়ার ফলে নানারকম অসুখে ভুগতে থাকে মা ও শিশু। আর এর ফল হিসাবে এক সময় পরিবারে নেমে আসে অশান্তি।
হতাশাজনক বিষয় হলো, উপকূলীয় অঞ্চলের শিশুদের এভাবেই দিন দিন মৌলিক অধিকার খর্ব হচ্ছে; বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে থাকা শিশুদের। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধ্বংসী বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয়গুলো বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার শিশুদের জীবন ও ভবিষ্যৎকে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে ফেলেছে, যা বিশ্বের অন্য কোনো রাষ্ট্রে এতটা বিরূপ প্রভাব নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেনি। এ অবস্থায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী শিশুদের ব্যবহার করছে সামান্য টাকার বিনিময়ে; এমন কী মাদকদ্রব্য বহনের কাজেও শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। দেখা গেছে, মাদকের সঙ্গে পরিচয় ঘটার পর এক সময় তারাও মাদকাসক্তও হয়ে পড়েছে।
পরিস্থিতির শিকার হওয়া এসব শিশুর শিক্ষা, মানবাধিকার ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য। বন্যায় বারবার বাড়িঘর ভেঙে যায় বলে হতদরিদ্র পরিবারগুলো বসবাসের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্বল কাঠামোয় ঘর তোলে। এগুলো সাধারণত বসবাসের অনুপযোগী থাকে; কিন্তু তবু সেখানেই প্রজন্মের পর প্রজন্মের জীবন কেটে যায়।
বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও খরার মতো বিরূপ আবহাওয়াজনিত ঘটনার সম্মিলন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, লোনা পানির অনুপ্রবেশ ইত্যাদি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি ঘটনাগুলো ওইসব পরিবারকে আরও বেশি দরিদ্র্য করছে ও স্থানচ্যুতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এতে শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ শিশুর বসবাস শক্তিশালী নদীপ্রবাহের পাশে।
নদীগুলো বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নিয়মিত নদীর তীর ভাঙে। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো সুস্পষ্ট, যা সামঞ্জস্যহীনভাবে শিশুদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং নানামুখী অপরাধে অভিযুক্ত হচ্ছে তারা। এ অবস্থায় শিশুদের জন্য সহনীয় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা গেলে শিশুদের মানবিক গুণাবলি বিকশিত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তাই দ্রুত দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করে শিশুদের জন্য নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে সক্ষমতা অনুযায়ী শিশুদের গড়ে তুলতে হবে। কোভিড-১৯ ও জলবায়ু পরিবর্তনে শিশুদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি সমাজে যে প্রকট বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে, দ্রুত তার সমাধান করা না হলে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলে মুখ থুবড়ে পড়বে উজ্জ্বল আগামীর ভবিষ্যৎ কান্ডারিরা, যা মোটেই কাম্য নয়।
ফাতিমা পারভীন
ভাইস চেয়ারম্যান, পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদ, বরগুনা
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: