পরিবেশ সংরক্ষণে পাটচাষের ভূমিকা
![ছবি: সংগ্রহীত](https://poribeshtv.com/uploads/shares/2019/Jute_Plant-2019-10-18-14-15-55.jpg)
দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধিতে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রযুক্তির প্রভাব দৃশ্যমান মাত্র। এ বিষয়ে গবেষণা করে অধ্যাপক উইলিয়াম নর্ডহাউস ও অধ্যাপক পল এম রোমার অর্থনীতিতে এবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। পাট একটি প্রাকৃতিক তন্তু এবং এটা বাংলাদেশের কৃষিপণ্য শিল্পের কাঁচামাল। বঙ্গীয় বদ্বীপ বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু পাটচাষে অত্যন্ত উপযুক্ত এবং পাটচাষীরাও অভিজ্ঞ। পাট ও পাটজাত দ্রব্য পরিবেশবান্ধব। পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ করে, ‘কার্বন নিঃসরণ’ হ্রাসে পাটচাষ বিশেষ ভূমিকা রাখে। পাট কৃষিজ ফসল হলেও ‘C’ Type উদ্ভিদ, তাই দ্রুত Photosynthesis হয় বলে এর উৎপাদনকাল ১২০ দিন। Bio-mass উৎপাদন পাটের ক্ষেত্রে প্রতিদিন প্রতি হেক্টরে ৯৮ কেজি, অন্যসব উদ্ভিদের ক্ষেত্রে মাত্র ২৮ কেজি, তাই পাট দ্রুত বৃদ্ধিশীল বৃক্ষও বটে। অপরপক্ষে একটি বাঁশ জাতীয় বৃক্ষের উৎপাদনকাল ৩-৫ বছর। অপর সব উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি। বনায়ন বা বৃক্ষ কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে অন্যতম উপায় হলেও পাটের অবস্থান অন্যান্যের চেয়ে অধিক সাশ্রয়ী। এটা renewable source of biomass হিসেবে পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিটি পাটগাছে ১১০-১২০ পাটপাতা থাকে এবং প্রতি হেক্টর পাটচাষ ১৫ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে এবং ১১ টন অক্সিজেন বিতরণ করে। অপরদিকে পাটচাষে জমির Ligno mass সৃষ্টির ফলে উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বৈশ্বিক তাপমাত্র বৃদ্ধির গতি কমাতে নানাবিধ প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। উন্নত দেশগুলো মূলত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশদূষণ অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। তাই টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিবেশবন্ধাব প্রযুক্তি তথা গ্রিন প্রযুক্তির জন্য আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা দূর, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, দেশি সম্পদের সর্বাধিক ব্যবহারে লাগসই প্রযুক্তি বিষয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা, পর্যালোচনার অভাব নেই; কিন্তু সত্যিকারের বাস্তবতা ভিন্ন। বিগত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে কানাডায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কানাডা পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণে ‘চ্যাম্পিয়ন’ হলেও দুঃখের বিষয় টরন্টো, অটোয়ার মতো সিটিতে আইন করেও তারা পলিথিন-প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আইন আছে; কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। তবে পলিমার ট্রেটেট পেপার ব্যাগের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ণধৎশফুষব টরন্টোর অন্যতম বৃহৎ বিপণন কেন্দ্র। ২ ঘণ্টা ঘুরে একটি দোকানে ইন্ডিয়া মেইড পাটের ব্যাগ পাওয়া গেছে। তবে ব্যাগের ডিজাইন মোটেই চিত্তাকর্ষক নয়।
প্রযুক্তি উন্নয়নে সমাজ বদলাচ্ছে। সমগ্র বিশ্ব আজ প্রযুক্তি পরিবর্তনে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের পর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়েছে ও তা সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে অনুন্নত বিশেষ করে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শিল্পবিপ্লবের সব স্তর একই সঙ্গে বিরাজমান হয়ে এক অস্বাভাবিক ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। উন্নত দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে নতুন নতুন প্রযুক্তিনির্ভর ভোগ্যপণ্যের বাজার সৃষ্টি করে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশে অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অভিনব শোষণের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে চলছে। তাই যে কোনো ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রযুক্তি শনাক্ত ও ব্যবহার করা আজ একটি জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে রয়েছে Consultant-দের উপদ্রব। তাই টেকসই প্রযুক্তি নির্ধারণ করার প্রয়োজনীতা দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে কারিগরি, অর্থনৈতিক-সামাজিক সব প্রভাব বিবেচনা রাখা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশ পরিবেশ তথা জলবায়ু পরিবর্তনে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। অপরদিকে পরিবেশদূষণে আমাদের অবদান অতি নগণ্য। তবে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সরকার ও সুশীলসমাজ নানাভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। MDG/SMDG, GO/NGO নানা ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। Vision 202 ও 2100 Delta প্রকল্প গ্রহণে পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে নজর রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্স ইন্সটিটিউট (পিআরআই) গোলটেবিল বৈঠকে আলোচিত হয়েছে, দেশে বর্তমানে প্রতিনিয়ত কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ১৯৭০-২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৭ শতাংশ হারে কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি পেলেও সম্প্রতি এটি ৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে এমনটা হচ্ছে এবং এটি স্বাভাবিক। উন্নত বিশ্বে মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ১৪-১৬ টন, বাংলাদেশে যা কয়েক কেজি মাত্র (২-৩ কেজি)। তাই পরিবেশ দূষণ কমিয়ে আনতে উন্নত বিশ্বে ডিজেল, পেট্রলসহ জ্বালানি তেলের ব্যবহারের ওপর বিদ্যমান করের বাইরে মাশুল হিসেবে ১০ শতাংশ কার্বন ‘কর’ আরোপ করা হয়ে থাকে; যা যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, ইতালি ও ফ্রান্সে যথাক্রমে ৭১, ৬৯, ৬৮ ও ৬৬ শতাংশ। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে কার্বন নিঃসরণ উল্লেখ করে সংস্থাটি বলেছে, দেশে অনুরূপ ১০ শতাংশ কার্বন কর আরোপ করা হলে সরকার বর্তমানে প্রথম বছর ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ও ২০৪১ সালে ২২ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব আহরণ করতে পারবে। ওই বৈঠকে অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বিশ্বব্যাপী নানা আলোচনা, আন্দোলন, গবেষণা, প্রযুক্তি, উন্নয়ন, প্রকল্প গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যাপক নজর দেয়া হয়েছে। উন্নত-অনুন্নত সব দেশে গবেষণা চলছে। নতুন নতুন গবেষণার দ্বার খুলছে, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, টেকসই প্রযুক্তি, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, স্থানীয়-দেশিও সম্পদের সর্বাধিক ব্যবহারের কথা পুনঃপুনঃ উচ্চারিত হচ্ছে। কেউ বসে নেই।
যে কোনো দেশের উন্নয়নে বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশিদের দেখাদেখি এমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া উচিত হবে না, যা আমাদের উন্নয়নের গতিপথে স্থবিরতা সৃষ্টি করতে পারে। বিদ্যুৎ ও পরিবহনের উন্নয়নে তথা শিল্প স্থাপন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, বিভিন্ন রকম সার্ভিস-সেবা- সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতে হবে। পরিবেশ দূষণ তথা জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী নতুন নতুন চিন্তার বিকাশ ঘটছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে জলবায়ুর পরিবর্তন এবং প্রযুক্তির ভূমিকা বিষয়ে অধ্যাপক উইলিয়াম নর্ডহাউস ও অধ্যাপক রোমার চলতি বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য জ্বালানি অপরিহার্য। কিন্তু জ্বালানি থেকেই উৎপন্ন হয় গ্রিনহাউস গ্যাস, যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ। জলবায়ু পরিবর্তন তাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন ও অর্থনীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অধ্যাপক নর্ডহাউস এ বিষয়ে কয়েকটি মডেল উদ্ভাবন করেন। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রকৃত প্রভাব পরিমাপে সক্ষম হয়েছেন তিনি এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম কীভাবে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পকির্ত হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে সেটিও তিনি হাতে-কলমে দেখিয়েছেন।
সাধারণভাবে মানুষের ধারণা, পরিবেশ রক্ষা করা ব্যয়বহুল ও কঠিন কাজ। তাই এটাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত। তবে পরিবেশ রক্ষা করেও টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভব। তাই অধ্যাপক রোমার আশা প্রকাশ করেন, বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস এবং ভবিষ্যতে জীবনযাত্রার মান উন্নত করে, ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সুযোগ ছাড় না দিয়েই পরিবেশ সুরক্ষায় যথাযথ অগ্রগতি অর্জন সম্ভব। কারণ প্রযুক্তি দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নেয়। এ ক্ষেত্রে দেশীয় সম্পদের সর্বাধিক ব্যবহারে উপযুক্ত প্রযুক্তি নির্ধারণ ও টেকসই উন্নয়ন নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে।
অত্যন্ত জনবহুল ছয় ঋতুর বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে দেশীয় সম্পদ ও টেকসই প্রযুক্তির বিকল্প খুবই নগণ্য। পরিবেশ সংরক্ষণে ত্রিমুখী ধারা- সম্মিলিত কার্যক্রম, পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এই ত্রিমুখী কার্যক্রমে পাটচাষ ও ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণসহ জলবায়ু পরিবর্তন তথা বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাস কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব। কার্বন নিঃসরণ হ্রাস ওপরে আলোচিত হয়েছে। উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব Jute geotextiles প্রযুক্তি ব্যবহার আজ সর্বজনস্বীকৃত। বাংলাদেশ আর্মি ফোর্স, ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ন এ বিষয়ে হাতিরঝিল ও পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েকটি উল্লেখ্যযোগ্য উন্নয়নমূলক কাজ করেছে, তেমিনভাবে গ্রামীণ রাস্তা, স্বল্প স্রোত, নদীভাঙন, সড়ক জনপথ ও রেল সড়ক উন্নয়ন ক্ষেত্রেও জুট জিও টেক্সটাইল ব্যবহার করা সম্ভব।
প্রফেসর ড. এবিএম আবদুল্লাহ : অধ্যাপক, প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক ডিজি, বিজেআরআর
বিষয়: পাট চাষ Jute Plant
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: