ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

দস্যুমুক্ত সুন্দরবন: শান্তি-সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন


প্রকাশিত:
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৬:১৪

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ২২:০২

 

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ঐশ্বর্যের অপূর্ব লীলাভূমি সুন্দরবন। ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ খ্যাত এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আমাদের গর্বের প্রতীক। সুন্দরবনের বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রাহরিণসহ এই সুন্দরবনের সম্পদ প্রাচুর্য এবং জীববৈচিত্র্য আমাদেরকে বিশ্বের দরবারে বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে। ফলে দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক ও দর্শনার্থী সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আগমন করে থাকেন।

সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। এ বনের বৃক্ষকুলের মধ্যে অন্যতম হলো সুন্দরী বৃক্ষ। এ বনে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী বৃক্ষ জন্মে বলেই এ বনকে সুন্দরবন নামকরণ করা হয়েছে। সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যতম বৈচিত্র্যপূর্ণ বন। যার স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেসকো (UNESCO) ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবনকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে। এ বিরল সম্মাননা বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা।


বিচিত্র সব প্রাণীর বাস সুন্দরবনে। সুন্দরবনে প্রায় ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং আট প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। সুন্দরবনের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার পৃথিবী বিখ্যাত, যার এক মাত্র আবাসস্হল এই সুন্দরবন। ২০০৪ সালের হিসাব মতে, সুন্দরবন প্রায় ৫০০ রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাঘের আবাসস্হল। সুন্দরবনে পর্যটকদের আরেকটি অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে মায়াবী চিত্রল হরিণ। বন বিভাগের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বন্যপ্রাণী রক্ষায় যথাযথ তত্পর থাকলেও কিছু অসাধু চোরা শিকারি চক্র বিভিন্ন কৌশলে এসব বন্যপ্রাণী শিকার করে পাচার করছে। ২০১১ সালের এক সরকারি প্রতিবেদনে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩০০টি। এছাড়া সুন্দরবনে রয়েছে বানর, বনবিড়াল, লিওপার্ড, শজারু, বন মহিষ, উদ, কুমির, সাপ, টিকটিকি এবং বন্য শূকরসহ অনেক বিচিত্র প্রাণী। বর্তমান সরকার সুন্দরবনের এই অমূল্য প্রাণী সম্পদ রক্ষার্থে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ পাচাররোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কতৃ‌র্ক বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য সফল অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে। ২০১৫ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং সচেতনতা সৃষ্টির কাজে বিশেষ অবদান রাখায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক র্যাব ফোর্সেসকে Bangabandhu Award for Wildlife Conservation -২০১৫ প্রদান করা হয়।

সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য এক বিরাট আয়ের উত্স। এ বনের আশপাশ ঘিরে ৪৫০টির মতো নদী ও খাল জালিকার মতো বিস্তৃত রয়েছে। এসব নদী ও খাল থেকে বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি, সাদা মাছ, কাঁকড়া আহরণ করে তা স্হানীয় বাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্হানে বিক্রি করে হাজার হাজার জেলে পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সুন্দরবনের মধুর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। প্রতি বছর এ বন থেকে ১৫ থেকে ১৬ হাজার মণ মধু আহরিত হয়ে থাকে। সুন্দরবনের মধুর ওপর নির্ভর করে প্রায় ১০ হাজার মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। সুন্দরবনের বনজ সম্পদকে কেন্দ্র করে কয়েকটি শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে খুলনা নিউজপ্রিন্ট ও হার্ডবোর্ড মিলস উল্লেখযোগ্য। সুন্দরবনের গোলপাতা শুকিয়ে ঘরের চাল ও বেড়া তৈরিতে ব্যবহূত হয়। প্রতি বছর হাজার হাজার দেশি ও বিদেশি দর্শনার্থী, পর্যটক, পর্যবেক্ষক, জাহাজ, বণিক আসছে সুন্দরবনের এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। আর এভাবেই সুন্দরবন দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার হিসেবে স্বীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ করছে।


কিন্তু একদা জলদস্যু ও বনদস্যুদের অভয়ারণ্য ছিল সুন্দরবন। জেলে, বাউয়ালি, মৌয়াল এমনকি বনরক্ষী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও দসু্যরা ছিল ‘মূর্তিমান আতঙ্ক’। তাদের উত্পাত ঠেকাতে সরকার ২০১২ সালে র্যাব ফোর্সেসের মহাপরিচালক’কে প্রধান করে সুন্দরবনের দসু্য দমনের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠিত হয়। টাস্কফোর্স গঠনের ফলে বেগবান হয় সুন্দরবনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান। র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২৩টি অভিযানে অন্তত ১৩৫ জন সন্দেহভাজন জলদসু্য ও বনদসু্য নিহত হয়েছে, গ্রেফতার হয়েছে পাঁচ শতাধিক দসু্য। লিড এজেন্সি হিসেবে র্যাবের ক্রমাগত সাঁড়াশি অভিযানে জলদসু্য-বনদসু্য বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। দিশেহারা হয়ে দসু্যরা ফেরারি জীবনের অবসান ঘটিয়ে আত্মসমর্পণের পথ খুঁজতে থাকে। র্যাব, কোস্ট গার্ড, পুলিশ ও বন বিভাগের সক্রিয় প্রচেষ্টায় অবশেষে ২০১৬ সালের ৩১ মে মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দরবনের দসু্যমুক্তকরণ কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন বছরে সর্বমোট ৩২টি বাহিনীর ৩২৪ জন দসু্য আত্মসমর্পণ করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৪২৬টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ ২২ হাজার ৫০৪ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। গত ১ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুন্দরবনকে দসু্যমুক্ত ঘোষণা করেন। সুন্দরবনকে দসু্যমুক্ত ঘোষণার মাধ্যমে সুন্দরবনের প্রায় ৪০০ বছরের দসু্যতার অবসান ঘটে।

শুধু তা-ই নয়, আত্মসমর্পণকৃত দসু্যদের অতিদ্রুত সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আনতে ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সরকার তাদের ১ লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। এমনকি র্যাবের পক্ষ হতে প্রত্যেক আত্মসমর্পণকৃত দসু্যকে অর্থ সাহাঘ্য, শীতবস্ত্র ও মোবাইল ফোন প্রদান করা হয়। গত ১ নভেম্বর ২০২১ তারিখ র্যাব ফোর্সেস সদর দপ্তরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কতৃ‌র্ক আত্মসমর্পণকৃত ১০২টি দসু্য পরিবারকে নির্মিত ঘর, ৯০টি পরিবারকে নির্মিত মুদি দোকান, ১১৪টি পরিবারকে বাছুরসহ গাভি, আটটি পরিবারকে ইঞ্জিনসহ নৌকা এবং ১২টি পরিবারকে জালসহ নৌকা প্রদান করা হয়। সর্বমোট ৩২৬টি পরিবারকে পুনর্বাসন সহায়তা দেওয়া হয়। সামাজিকভাবে যেন কোনো দসু্যকে হেয় প্রতিপন্ন ও লাঞ্ছনার শিকার না হতে হয়। সেজন্য আত্মসমর্পণকৃত দসু্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সরকারের নির্দেশনায় র্যাব কর্তৃক সার্বিক আইনি সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। তাছাড়াও বিভিন্ন উত্সব, ঈদ, পূজা ও করোনাকালীন সহায়তার প্রদানের পাশাপাশি তাদের সামাজিক নিরাপত্তা ও আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করছে র‌্যাব ফোর্সেস।

ইদানীং সুন্দরবনে বাঘ, হরিণ ও পশুপাখি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুন্দরবন উপকূলীয় লোকজনসহ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মান বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুন্দরবনে দেশি-বিদেশি দর্শনার্থী ও পর্যটকদের আগমন বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও সুন্দরবন দসু্যমুক্ত হওয়ায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা পেয়েছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে র্যাব সুন্দরবনের জলদস্যু, বনদস্যু ও পাচারকারী দমনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। সুন্দরবন এলাকায় জলদস্যু, বনদস্যু ও পাচারকারী এর অপতত্পরতা রোধকল্পে এবং উক্ত এলাকায় র্যাবের উপস্হিতি নিশ্চিতকল্পে নিয়মিত হেলিকপ্টার পর্যবেক্ষণ অপারেশন (Heli recce) পরিচালনা করা হচ্ছে। সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত রাখার পাশাপাশি ফলপ্রসূ অভিযান পরিচালনার জন্য সুন্দরবনের দুবলারচর এলাকায় র্যাবের একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। বর্তমানে সুন্দরবনে আরো দুটি ক্যাম্প স্হাপনের জন্য প্রস্তাবনা প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়াও দস্যুমুক্ত সুন্দরবন বাস্তবায়নের জন্য সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিসহ নিয়মিত টহল ও আভিযানিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পরিস্হিতি মূল্যায়ন করা হচ্ছে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বনজ সম্পদ, কর্মসংস্হান, প্রাণী ও উদ্ভিদের বিচিত্রতা, বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল ও বিপুল প্রাকৃতিক অক্সিজেনের জোগান দিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে ও বিভিন্ন প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে রক্ষা পেতে সুন্দরবনের ভূমিকা অপরসীম। এই প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপূর অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবনকে টিকিয়ে রাখতে দসু্যমুক্ত সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। সুন্দরবনকে দসু্যমুক্ত রাখা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আমাদের সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই পারে এক মাত্র সরকার কর্তৃক ঘোষিত সুন্দরবনকে দসু্যমুক্ত রাখতে।

 

লেখক:
লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ মোসতাক আহমদ, বিএসপি, পিএসসি
অধিনায়ক, র‌্যাব-৬, খুলনা

সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক 


বিষয়:



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top