ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১


করোনার জেএন.১ ধরন ও ঝুঁকি


প্রকাশিত:
২৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৭:১০

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ০৭:১০

প্রতীকী ছবি

এ মাসের প্রথম ২৪ দিনে ১২৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচজন। এই প্রবণতা বেশ দীর্ঘ সময় ধরে চলছে। আর স্বল্প সংখ্যায় এই সংক্রমণের কারণে মানুষ প্রায় ভুলতে বসেছে করোনার কথা। তবে হঠাৎ করে কোভিড-১৯–এর জেএন.১ নামের এক উপধরন ধাক্কা দিয়েছে।

ইতিমধ্যে পার্শ্ববর্তী ভারতসহ বিশ্বের ৪১টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এ ধরন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যে একে ‘ভেরিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’বা এর দিকে নজর রাখার মতো ধরন বলেছে। বলা হচ্ছে, এটি অতি দ্রুত ছড়াচ্ছে। আর ভীতিটা সেখানেই। আর প্রতিবেশী দেশে এর ধরন ছড়িয়ে পড়ার কারণে আমাদের শঙ্কা আছে।

আগের অভিজ্ঞতা বলছে, পার্শ্ববর্তী দেশে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাস বাংলাদেশেও আসতে সময় নেয় না। করোনার নতুন এই উপধরন, এর বৈশিষ্ট্য, এর শঙ্কার দিক, এ ধরন রুখে দেওয়ার ক্ষেত্রে টিকার কার্যকারিতা কতটুকু, এটি প্রতিরোধে সরকারের প্রস্তুতি—এসব নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে দেশের ভাইরোলজিস্ট, চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্যবিদদের সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, অমিক্রনের উপধরন হলো জেএন.১। রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে ফাঁকি দেওয়ায় জেএন.১ আরও অনেক বেশি কার্যকর। ফলে এর সংক্রমণের হার বেশি। তবে এর ঝুঁকি কম।

 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনার অমিক্রন ধরনের একটি উপধরন ছিল বিএ২.৮৬ নামের একটি ধরন। আর সেখান থেকেই এসেছে জেএন. উপধরনটি।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, প্রতিটি ভাইরাসের গায়ে কাঁটার মতো স্পাইক প্রোটিন থাকে। এরাই মানব শরীরে প্রবেশ করে কোষগুলো আক্রান্ত করে, নানা উপসর্গ সৃষ্টি করে।

অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ এর মতে, জেএন.১ আক্রান্তদের শরীরে যে উপসর্গ দেখা গেছে, তা অপেক্ষাকৃত কম। সাধারণ সর্দি–কাশির ক্ষেত্রে যেমন উপসর্গ হয় জেএন.১ আক্রান্তদের ক্ষেত্রে এমনটাই হচ্ছে। এতে ফুসফুসের সংক্রমণ বেশি হয় তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আবার এতে আক্রান্তদের আইসিইউ পর্যন্ত যেতে হয়েছে তার নজিরও কম।

এসব স্পাইকের মিউটেশন বা চরিত্র পরিবর্তনের নতুন কোনো ধরন বা উপধরনের সৃষ্টি হয়। অমিক্রনের একটি উপধরন হলো জেএন.১। রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে ফাঁকি দেওয়ায় জেএন.১ আরও অনেক বেশি কার্যকর। ফলে এর সংক্রমণের হার বেশি।

 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিটি ধরন তাদের গতি, সংক্রমণের প্রকৃতি এবং উপসর্গের দিক দিয়ে ভিন্নতর হয়।

 

যুক্তরাষ্ট্রের দ্য সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অমিক্রনের বিএ.২.৮৬ ধরনটির স্পাইক প্রোটিনে ২০টি মিউটেশন আছে। আর জেএন.১–এ আছে ২১টি। এই অতিরিক্ত মিউটেশনটার নাম দেওয়া হয়েছে এল৪৫৫এস।

 

জেএন. নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বজুড়ে করোনার রোগী আবার বেড়ে গেছে। তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ নভেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২৮ দিনে এর আগের ২৮ দিনের চেয়ে বিশ্বব্যাপী করোনার রোগী বেড়েছে ৫২ শতাংশ। এ সময় সাড়ে আট লাখ নতুন রোগী আক্রান্ত হয়েছে। সর্বশেষ চার সপ্তাহে এর আগের সময়ের তুলনায় মৃত্যু অবশ্য কমেছে ৮ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে করোনার সংক্রমণ ঘটেছে মূলত জেএন.১-এর উপধরনের কারণে। সর্বশেষ সপ্তাহে বিশ্বের মোট আক্রান্তের ২৭ শতাংশের বেশি ঘটেছে এই উপধরনে। তিন সপ্তাহ আগে এই উপধরনে আক্রান্তের হার ছিল ৩ শতাংশের বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এটি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।

জাতিসংঘের সংস্থাটির কোভিড-১৯ বিষয়ে কারিগরি বিভাগের প্রধান মারিয়া ফর কারকোভ এক বিবৃতিতে বলেছেন, তাঁরা সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে নিবিড়ভাবে নতুন এ ধরনের বিষয়টি পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন। এ–সংক্রান্ত যেকোনো উপাত্ত দেওয়ার জন্যও তাদের অনুরোধ করা হয়েছে।

 

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম জেএন. উপধরনটি শনাক্ত হয়। সিডিসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রথম মাসে দেশটিতে করোনায় আক্রান্তদের মাত্র শূন্য দশমিক শতাংশ উপধরনে আক্রান্ত হয়। ডিসেম্বরের ৮ তারিখের হিসাব অনুযায়ী, মোট শনাক্তের ২৯ শতাংশ জেএন.১ উপধরনে আক্রান্ত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘জেএন.১ আক্রান্তদের শরীরে যে উপসর্গ দেখা গেছে, তা অপেক্ষাকৃত কম। সাধারণ সর্দি–কাশির ক্ষেত্রে যেমন উপসর্গ হয় জেএন.১ আক্রান্তদের ক্ষেত্রে এমনটাই হচ্ছে। এতে ফুসফুসের সংক্রমণ বেশি হয় তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আবার এতে আক্রান্তদের আইসিইউ পর্যন্ত যেতে হয়েছে তার নজিরও কম।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতিগতভাবেই জেএন.১ কম আক্রমণাত্মক। এটি অমিক্রনের একটি উপধরন। অমিক্রন সারা বিশ্বে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল বটে। কিন্তু তখনো অমিক্রনে আক্রান্তদের অধিকাংশই ঘরে থেকেই সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন।

যখন কোনো রোগে সংক্রমণ বেশি হয়, তখন স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর প্রভাব পড়ে। রোগী বেশি হলে হাসপাতালগুলোতে চাপ সৃষ্টি হয়। স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিঘ্ন ঘটে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, রোগ যাতে বেশি না ছড়ায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। আর জেএন.১ কম ক্ষতিকর হলেও বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তি, শিশু, অন্তঃসত্ত্বা ও যাঁদের কোমরবিডিটি (একই সঙ্গে থাকা একাধিক রোগ) আছে, তাঁদের জন্য বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। 

 

অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘একে একেবারে হেলাফেলা করার কোনো কারণ নেই। বিশেষ করে যাঁদের কোমরবিডিটি আছে এবং যাঁরা বয়স্ক। তাই করোনাকালে নেওয়া নানা ধরনের স্বাস্থ্যবিধি এখন আবার জোরদার করা দরকার। হাত ধোয়ার অভ্যাস যেন আমরা ভুলে না যাই। আবার হাসপাতালগুলোতে নেওয়া ব্যবস্থাপনাও ফিরিয়ে আনা দরকার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য তুলে ধরে অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, নতুন উপধরনটি প্রতিরোধে করোনার টিকাগুলো কার্যকর বলেই ধরা হচ্ছে। তাই নতুন কোনো টিকার দরকার নেই। নতুন উপধরনে টিকা সুরক্ষা দেবে, এটা ভালো খবর।

 

বাংলাদেশের ঝুঁকি কোথায়, প্রস্তুতি কী

জেএন.১  উপধরনটি ভারতে সংক্রমণ ঘটাতে শুরু করেছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে ভারতের কেরালায় প্রথম এ ধরনটি শনাক্ত হয় ৭৯ বছর বয়সী এক নারীর দেহে। ভারতে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১ জনের এ ধরনে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

প্রতিবেশী এ দেশে সংক্রমণ হওয়ার কারণে বাংলাদেশ যে ঝুঁকিতে আছে, তা মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। কারণ, অতীতেও দেখা গেছে, ভারতে ছড়ানো করোনার একাধিক ধরন বাংলাদেশে ছড়িয়েছে। জেএন.১ উপধরনটি বাংলাদেশে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে চলে আসতে পারে বলে মনে করেন  মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সাধারণত শীত একটু কমে গেলে করোনার বিস্তার ঘটেছে। ফেব্রুয়ারিতে শীত কমতে থাকবে। উত্তর গোলার্ধে শীতের সময় এ ভাইরাস ছড়ালেও আমাদের এখানে ভিন্ন। তাই এই ভাইরাস মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি থাকা দরকার।’

আইইডিসিআর ভাইরাসের ওপর নজরদারি করে। প্রতিনিয়ত তারা ভাইরাসের জিনগত নকশা (জেনোম সিকোয়েন্সিং) উন্মোচনের কাজ করে। নতুন এ ধরনটির বিষয়ে সজাগ বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। দেশের প্রবেশ পথগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’

 




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top