ঢাকা শনিবার, ১২ই অক্টোবর ২০২৪, ২৮শে আশ্বিন ১৪৩১


বাংলাদেশের পুকুরে মাছ চাষের ‘নীল বিপ্লব’


প্রকাশিত:
১৫ অক্টোবর ২০১৯ ২৩:২২

আপডেট:
১২ অক্টোবর ২০২৪ ১৪:৩৪

ফাইল ছবি

পরিবেশ টিভি: গোসল করা, কাপড় ধোয়া, বাসন পরিষ্কার—মূলত এসব কাজেই গ্রামের পুকুরগুলো ব্যবহৃত হতো। কিছু পরিবার ঘরের চাহিদা মেটাতে নিজেদের পুকুরে মাছের চাষ করত। অনেকে খাওয়ার পানির চাহিদা মেটাত পুকুর থেকে। তিন দশক আগের এই চিত্র এখন আমূল পাল্টে গেছে। দেশে উৎপাদিত মাছের বেশির ভাগই এখন আসে পুকুর থেকে। খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) বলছে, পুকুরে মাছ চাষে অনন্য দৃষ্টান্ত সারা বিশ্বে স্থাপন করেছে বাংলাদেশ।

অভূতপূর্ব এ ঘটনাকে ইফপ্রি ‘নীল বিপ্লব’ বলে উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশের মাছ চাষ নিয়ে চার বছরে সাতটি গবেষণা করেছে ইফপ্রি। চার গবেষণার ফলাফল এ মাসের শেষ দিকে ঢাকা ও ওয়াশিংটনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করবে তারা। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উৎপাদিত মাছের ৫৬ শতাংশ এখন আসছে পুকুর থেকে। পুকুরে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষের ফলে দেশে মাছের মোট উৎপাদন গত ৩৪ বছরে ছয় গুণ বেড়েছে। আর শুধু পুকুরে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ১২ গুণের বেশি। দেশের প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এখন মাছ চাষ এবং এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। দেশের দারিদ্র্যবিমোচনের ক্ষেত্রে এই খাতের অবদান শীর্ষ তিনের মধ্যে রয়েছে। আর কর্মক্ষম মানুষের ২৩ শতাংশ এখন কোনো না কোনোভাবে মৎস্য খাতের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমাণ ১৯৯০ সালে ছিল বছরে সাড়ে ৭ কেজি, এখন তা ৩০ কেজি।

তিন দশক আগে পুকুরে মাছের উৎপাদন হতো ১ লাখ ৭৮ হাজার টন। এখন তা ১২ গুণের বেশি বেড়েছে। ধানের চেয়েও মাছ চাষ বেশি লাভজনক। প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ লোক মাছ চাষ এবং এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।

ইফপ্রির দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক শহীদুর রশীদের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, চীন, ইথিওপিয়া, গুয়াতেমালা ও বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ওই গবেষণা করেন। এ ধরনের সমন্বিত গবেষণা বিশ্বে এটিই প্রথম।

২০১৪ সাল থেকে শুরু করে ওই গবেষণা ২০১৮ সাল পর্যন্ত চলে। শহীদুর রশীদ ভারতের দিল্লি থেকে মুঠোফোনে গতকাল সোমবার বিকেলে বলেন, বাংলাদেশের মৎস্য খাতের এই বিপ্লব বিশ্বের উন্নয়ন অধ্যয়ন নিয়ে কাজ করা গবেষক ও অর্থনীতিবিদদের ধারণা বদলে দিয়েছে। বড় উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াও যে দারিদ্র্যবিমোচন ও গ্রামীণ উন্নয়ন হতে পারে, বাংলাদেশের মৎস্য খাত তার প্রমাণ। গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র চাষিদের সৃজনশীল উদ্যোগ, সরকারের নীতি সহায়তা ও বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন—সব মিলিয়ে এই সফলতা এসেছে। তিনি বলেন, মাছের উৎপাদন বাড়ায় দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। ধানের চেয়েও মাছ চাষ বেশি লাভজনক। এক একর জমিতে ধান হয় দুই থেকে তিন টন। আর এক একর আয়তনের পুকুরে মাছ হয় ৪০ টন।

মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে, বাংলাদেশে ২০১৭-১৮ সালে মোট মাছের উৎপাদন হয় ৪২ লাখ ৭৬ হাজার ৬৪১ মেট্রিক টন। এর মধ্যে পুকুরে উৎপাদিত হয় ২৪ লাখ ৫ হাজার ৪১৫ টন। অথচ ১৯৮৩-৮৪ সালে পুকুরে মাছের উৎপাদন ছিল মাত্র ১ লাখ ৭৮ হাজার টন। মূলত দেশের ২৪টি জেলায় পুকুরে মাছের চাষ দ্রুত বেড়েছে। এর মধ্যে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও নেত্রকোনায় পুকুরের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এসব জেলায় পুকুরে মাছ চাষ বছরে ১০ শতাংশ হারে বেড়েছে। অন্যদিকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঘেরে মাছ চাষ গত দুই যুগে ২৪ শতাংশ কমেছে। সেখানেও পুকুরে মাছ চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী বলেন, শুধু পুকুরে মাছ চাষের জন্য বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছেন। মৎস্য অধিদপ্তর থেকে মাঠপর্যায়ে চাষিদের কাছে সরকার প্রযুক্তি ও সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। একই সঙ্গে উন্মুক্ত জলাশয়ে প্রতিবছর সরকারি উদ্যোগে মাছের পোনা ছাড়া হচ্ছে, যা মাছের সামগ্রিক উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করছে।

গবেষকেরা বলছেন, দুই যুগ আগে দেশে রুইজাতীয় মাছ সবচেয়ে বেশি চাষ হতো। এর পাশাপাশি তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছের চাষ অনেক বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নত জাতের কই মাছের চাষও বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ মৎস্য ইনস্টিটিউট থেকে ইতিমধ্যে মৎস্য চাষ ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক ৬০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ১৮টি মাছের পোনা উৎপাদন করেছেন বিজ্ঞানীরা।

তবে এই সফলতার সঙ্গে সঙ্গে মাছ চাষে ঝুঁকিও বাড়ছে বলে ইফপ্রির গবেষণায় বলা হয়েছে। পুকুর পরিষ্কার করতে ব্যবহার করা চুন এবং অন্যান্য ওষুধ ও রাসায়নিকের ব্যবহার বাড়ছে। আবার কারখানায় বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত খাদ্য মাছকে খাওয়ানো হচ্ছে। এসবের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। পুকুর পরিষ্কার ও খাবারের সঙ্গে থাকা বিভিন্ন রাসায়নিক মাছের শরীরে কতটুকু রয়ে যাচ্ছে, তার কোনো মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণ হচ্ছে না। বিশেষ করে মাছ রপ্তানি করতে গেলে মাছের গুণগত মান নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।

শুধু ইফপ্রি একা নয়, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকেও বাংলাদেশের মৎস্য খাতের এই পরিবর্তনকে বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলা হচ্ছে। গত জুনে এফএও প্রকাশিত বৈশ্বিক মৎস্য প্রতিবেদন অনুযায়ী, চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম বাংলাদেশ।

 

সূত্র: প্রথম আলো




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top