ঢাকা রবিবার, ৮ই সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৫শে ভাদ্র ১৪৩১


রাজশাহীসহ দেশের ৩৫ জেলায় বেড়ে উঠছে প্রাণঘাতী “পার্থেনিয়াম”


প্রকাশিত:
১ জুন ২০২৪ ১৮:৪৮

আপডেট:
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:২৪

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে বিষাক্ত আগাছা পার্থেনিয়াম। এতে মানুষ ও গবাদিপশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন বেড়েছে, তেমনি ফসল উৎপাদনও কমে আসছে। মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে জীব ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য। ধনিয়া গাছের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ এই আগাছাটি দুই দশক আগেও এই দেশে ছিল না। কিন্তু এখন এটি কেবল রাজশাহীর চারঘাটে নয়- সীমান্তবর্তী অন্ততপক্ষে ৩৫ জেলার ২৫ ধরনের ফসলের ক্ষেত থেকে শুরু করে প্রায় সব রাস্তার ধারে নির্বিঘ্নে বেড়ে উঠছে।

পার্থেনিয়াম (ইংরেজিতে Parthenium) আগাছাটি ডেজি পরিবারের মধ্যে সূর্যমুখী উপজাতের উত্তর আমেরিকান গুল্ম প্রজাতির বংশধর। শিরাযুক্ত, নরম কাণ্ডবিশিষ্ট একবর্ষজীবী গুল্মজাতীয় এ আগাছার নাম গ্রিক শব্দ (parthenos) থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ ‘কুমারী’ বা (parthenion)। এটির উৎপত্তি উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার সাব ট্রপিক্যাল অঞ্চল, মেক্সিকো ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে। বিশ্বের ২০টিরও বেশি দেশে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ আগাছার উচ্চতা দুই থেকে তিন ফুট, আয়ুকাল তিন থেকে চার মাস। চিকন সবুজ পাতার ফাঁকে ছোট ছোট সাদা ফুলে আকর্ষণীয় দেখায় গাছগুলোকে। ত্রিভুজের মতো ছড়িয়ে থাকে এর অসংখ্য শাখা।

ধারণা করা হচ্ছে পার্থেনিয়াম মূলত বায়ুর মাধ্যমে এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা খাদ্যশস্য ও বীজের মাধ্যমে এদেশে এসেছে। পরে অসতর্কতা ও অজ্ঞতার কারণে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে পার্থেনিয়ামের উপস্থিতি প্রথম শনাক্ত করা হয় যশোরে ২০০৮ সালে। তখন এ ব্যাপারে তথ্যানুসন্ধানে এদেশে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্টিভ অ্যাডকিনসের নেতৃত্বে একদল কৃষিবিজ্ঞানী। এদেশে ছড়িয়ে পড়া পার্থেনিয়ামের বৈজ্ঞানিক নাম Parthenium hysterophorus। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর ১৬টি প্রজাতির মধ্যে এটিই সবচেয়ে বিষাক্ত উদ্ভিদ। বাংলাদেশে এটি নাকফুল হিসেবে পরিচিত। পার্থেনিয়ামের তথ্যানুসন্ধানে ২০১৪-১৭ সাল পর্যন্ত দেশের ৩৫টি জেলায় জরিপ চালানো হয়। তাতে দেখা যায়, বিষাক্ত এই গাছটি ভারতের সীমান্তবর্তী বৃহত্তর যশোর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ অঞ্চলেই বেশি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ জানান, পার্থেনিয়াম উদ্ভিদটি নর্থ আমেরিকা ও মেক্সিকোর। ভারত উপমহাদেশে এসেছে ১৯৫৫ সালে আর বাংলাদেশে এসেছে আশির দশকে। এই উদ্ভিদ মূলত রাস্তার দু’ধারে কিংবা রেললাইনের ধারে বেশি দেখা যায়। এটি অত্যন্ত দ্রুত ছড়াতে পারে। জীবদ্দশায় একটি গাছ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার বীজ উৎপাদন করতে পারে।

রাস্তার দু’ধারে, বাড়ির আঙিনায় ও কৃষিজমির আলে, পরিত্যক্ত কৃষি ও অকৃষি জমিতে ছড়িয়ে পড়েছে এই প্রাণঘাতী বিষাক্ত আগ্রাসী আগাছা। শরীরে এর ছোঁয়া লাগলে হতে পারে দুরারোগ্য চর্মরোগ। এর ফুলের রেণু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে দেহে ঢুকলে হতে পারে শ্বাসকষ্ট। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে এটি মৃত্যুর কারণও হতে পারে। পার্থেনিয়াম ভক্ষণকারী গবাদিপশুও পড়তে পারে মৃত্যুঝুঁকিতে।

গবেষণায় জানা গেছে, পার্থেনিয়াম রাজশাহীর রাজঘাট ও পুঠিয়া এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় হলুদ, আদা, কলা, দেশীয় শিম, আমের বাগান ও মটর ক্ষেতকে আক্রান্ত করেছে। এই পরগাছাটি অ্যালিলোপ্যাথিক যৌগগুলোর মাধ্যমে বেগুন, টমেটো, মরিচ ইত্যাদির পরাগায়ন কমিয়ে ফেলে। গম, ভুট্টা, মরিচ, শিম, টমেটো ও বেগুনের ফল ও দানার গঠন এ আগাছার আক্রমণে ব্যাহত হয়।

চারঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো, আল মামুন হাসান বলেন, ‘এই বিষাক্ত আগাছা ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করছে। উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। এমনকি মানবদেহে ছোঁয়া লাগলে চর্মরোগ দেখা দেয়। গরু-ছাগল খেলে

তাদের পেটের পীড়া ও মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই গাছে ফুল আসার আগেই পুড়িয়ে ফেলা ও ধ্বংস করার জন্য কৃষকদের সচেতন করছি।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) চারঘাট উপজেলার সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এই উদ্ভিদ সম্পর্কে আমরা অধিকাংশ সাধারণ মানুষ কিছুই জানি না। শিশু-কিশোররা এ উদ্ভিদের পাতা ও ফুল নিয়ে খেলা করে নানা চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ উদ্ভিদকে ক্ষতিকর ঘোষণা করে ব্যাপক প্রচার চালানো দরকার।’

এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আশিকুর রহমান বলেন, ‘পার্থেনিয়াম আমাদের শ্বাসনালি ও চর্মতে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমরা কিছু চিকিৎসা দিয়ে থাকি। পার্থেনিয়ামের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় চুলকানো বা অ্যালার্জি থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষাক্ত আগাছা পার্থেনিয়ামের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা খুব বেশি এবং বাতাসের মাধ্যমে সহজেই এটি ছড়িয়ে থাকে। আগাছাটি জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও কৃষির জন্য নীরব ঘাতক। পৃথিবীর অনেক দেশেই পার্থেনিয়াম থেকে বায়োগ্যাস, বায়োফার্টিলাইজার ও আগাছা নাশক তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই উদ্ভিদের ব্যাপারে মানুষ সচেতন নন। রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ ও গবেষণা ছাড়া আগ্রাসী আগাছা পার্থেনিয়াম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে তারা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top