ঢাকা শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


ঢাকার বাড়িঘর তরল মাটিতে ডুবে যেতে পারে


প্রকাশিত:
৩ অক্টোবর ২০১৯ ০৭:৩৬

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:১০

ছবি: সংগৃহীত

ধরুন আপনার পায়ের নিচের যে শক্ত মাটি তার প্রকৃতি হঠাৎ বদলে গেল। এটি তরল পদার্থের মতো আচরণ শুরু করল। যে মাটির ওপর আপনি দাঁড়িয়ে আছেন সেটিতে ঢেউ খেলতে শুরু করলো। মাটির ওপরের সব বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, স্কুল, হাসপাতাল, সেতু ভেসে যেতে শুরু করলো। তারপর ধসে গিয়ে ডুবে গেল পানি-কাদা-বালির এক সমূদ্রে। বিষয়টা অবিশ্বাস্য মনে হলেও এমন ঘটনা সত্যিই ঘটেছে। কিছুদিন আগে ভূমিকম্পের পর ইন্দোনেশিয়ার পালুতে দেখা গেছে এমন দৃশ্য। তার আগে অতি সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডে, চিলিতে। আরও আগে জাপান এবং বিশ্বের আরও অনেক দেশে এমন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এমনটি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওলজি ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ড. আফতাব আলম খান বলছেন, ঢাকার অবস্থা খুবই নাজুক। পুরো ঢাকা শহরের ৬০ শতাংশ ভূমর গঠনপ্রকৃতি এমন যে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে এরকম ঘটনা ঢাকাতেও ঘটতে পারে। বিজ্ঞানীরা এ ধরনের ঘটনাকে বলেন ‘লিকুইফেকশন। একে সহজ বাংলায় বলা যেতে পারে মাটির তরলীকরণ। অর্থাৎ মাটি যখন তরল পদার্থের মতো আচরণ শুরু করে। ইন্দোনেশিয়ার সর্বশেষ ভূমিকম্পে লিকুইফেকশনের কারণে বালারোয়ার পালু এলাকায় প্রায় ১ হাজার ৭০০ বাড়িঘর কার্যত মাটিতে দেবে গিয়েছিল। স্যাটেলাইট থেকে নেওয়া ছবিতে দেখা গেছে, পালুর বিমানবন্দরের দক্ষিণে একটি বিরাট এলাকায় ঘরবাড়ির চিহ্ন পর্যন্ত নেই, সবকিছুই যেন মাটিতে মিশে গেছে।

ইন্দোনেশিয়ার গণপূর্ত মন্ত্রী বাসুকি হাদিমুলজোনো জানিয়েছেন, সেখানে ধ্বংস এবং মৃত্যুর প্রধান কারণ লিকুইফেকশন। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র সুতপা পারো নাগরোহো জানান, যখন ভূয়মিকম্প আঘাত হানল, মাটি যেন ঞুরঝুরে হয়ে গেল, কাদায় পরিণত হলো। এই বিপুল কাদায় পিটোবোর হাউজিং কমপ্লেক্স যেন ডুবে গেল। আমরা অনুমান করছি সেখানে কাদায় ডেবে আছে ৭৪৪ টি বাড়িঘর।” আর মুজাইর নামে একজন বার্তা সংস্থা এএফপিকে এ ভূমিকম্পের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, আমার বাড়ি যেন কার্যত রাস্তার কয়েক মিটার দূরে সরে গেল। আমার প্রতিবেশীদের বাড়িগুলো একটির ওপর একটি গিয়ে পড়ল। এর আগে ২০১০-১১ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্যান্টারবারি অঞ্চলে যে ভূমিকম্প হয়, তখনও ঘটেছিল এরকম ঘটনা। সেখানে পলিমাটি আর বালি পানির সঙ্গে মিশে ঢেউয়ের মতো উপরে উঠে এসেছিল। আর তার নীচে চাপা পড়েছিল রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, গাড়ি, বাগান, ক্ষেতখামার- সবকিছু।

২০১০ সালে চিলিতে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার এক ভূমিকম্প হয়েছিল। এতে চিলির মধ্য-দক্ষিণাঞ্চলে নিহত হয়েছিল ৮শ মানুষ। সেখানে মাটির তরলীকরণ বা লিকুইফেকশনের কারণে ধসে পড়েছিল ব্রিজ, বন্দর, বাঁধ থেকে অনেক কিছু। প্রায় ৯৫০ কিলোমিটার জুড়ে চলেছিল এই ধ্বংসযজ্ঞ। এমন ঘটনা জাপানে ঘটেছে অনেকবার। ১৯৬৪ সালে নিগাতায় এবং ১৯৯৫ সালে কোবে নগরীতে। কোবে নগরীর বন্দর তৈরি করা হয়েছিল একটি কৃত্রিম দ্বীপের ওপর। তুলনামূলকভাবে আলগা বালি এবং পলির ওপর তৈরি ওই বন্দর ভূমিকম্পে ধসে পড়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ড. আফতাব আলম খান বলছেন, বাংলাদেশের যে ভূকাঠামো, তাতে এরকম ঘটনা ঘটার ঝুঁকি অনেক। এটা একটা মারাত্মক সমস্যা। বাংলাদেশ খুবই নাজুক অবস্থানে। তিনি বলেন, ভূমিকম্প হলেই যে লিকুইফেকশন হবে, ব্যাপারটা তা নয়। কয়েকটি ব্যাপার একসঙ্গে ঘটতে হবে। এটা নির্ভর করবে ভূমিকম্প কতটা শক্তিশালী, মাটির কতটা গভীরে এটি ঘটছে এবং সেখানে যে একুইফার বা পানির স্তর আছে, সেটিতে কতটা পানি আছে তার ওপর। তার মতে যদি ভূমিকম্প ছয় মাত্রার কাছাকাছি বা এর চেয়ে শক্তিশালী হয় এবং এর উৎপত্তিস্থল যদি ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার গভীরতার মধ্যে হয়, তাহলে লিকুইফেকশনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

ড. আফতাব আলম খান বলেন, যখন ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি জায়গায় কোনো ফল্ট লাইন বা ফাটল বা চ্যুতি পরস্পরের সাপেক্ষে নড়াচড়া করে তখন সেটাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় ‘ফল্ট রাপচার’ বল হয়। এ ফল্ট রাপচার নতুন করে হতে পারে বা আগের রাপচার নতুন করে সক্রিয় হতে পারে। তবে রাপচার যে কারণেই হোক, ফাটল দুটিকে পরস্পরের সাপেক্ষে নড়তে হবে, নইলে লিকুইফেকশন হবে না। যখন ফল্ট লাইন বা ফাটল রেখাটি নড়াচড়া করে, তখন যে সিসমিক ওয়েভ বা ভূকম্পন তরঙ্গ তৈরি হয় এবং এ তরঙ্গ যখন লিকুইফেকশন জোনে এসে পৌঁছায়, তখন সেখানকার মাটি তরল পদার্থের মতো আচরণ করে।

ভূকম্পন তরঙ্গ যখন ভূপৃষ্ঠের ২০০ মিটারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন সেখানে যেসব একুইফার বা পানির স্তর থাকে, সেগুলো যদি পানিতে পরিপূর্ণ থাকে, তখন ওপরের মাটি ধসে যাবে এবং সেই মাটি তরল পদার্থের মতো আচরণ করবে। এতে ঢেউ খেলতে দেখা যাবে এবং ওপরে যা কিছু আছে সব ধসে পড়বে বা ভেসে যাবে। বালি এবং পানি মিলে একটি জেলি টাইপের জিনিস তৈরি হয়ে, যেটি ওপরে উঠে আসে। আর নিচে একুইফার জোনে একটি ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতা তৈরি হয়। তখন সেই শূন্যস্থানে ওপরের মাটি ধসে পড়ে। তখন ওপরে যত ধরনের স্ট্রাকচার থাকে, সেটা মাটিতে তলিয়ে যায়, মাটিতে ডুবে যায়।

ড. আফতাব আলম খানের মতে, বাংলাদেশে যদি বর্ষাকালে বড় ভূমিকম্প হয়, তখন লিকুইফেকশনের ঝুঁকি বেশি হবে। কারণ তখন বৃষ্টির পানিতে ভূগর্ভের পানির স্তর থাকে পরিপূর্ণ। সেই তুলনায় শীতকালের ভূমিকম্পে লিকুইফেকশনের ঝুঁকিটা অনেক কম। ড. আফতাব আলম খানের মতে, পুরো বাংলাদেশের বেশিরভাগই যেহেতু গড়ে উঠেছে নদীবিধৌত পলিমাটিতে। তাই এরকম লিকুইফেকশনের ঝুঁকি কম-বেশি অনেক জায়গাতেই আছে। কেবল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহীর মতো কিছু জেলায় অগভীর মাটিতে শক্ত শিলা বা ‘সলিড ক্রাস্ট’ আছে। যেখানে এর ঝুঁকি নেই। তার মতে ঢাকা শহরের অন্তত ৬০ শতাংশ এলাকা এরকম লিকুইফেকশন অঞ্চলে পড়েছে, যেখানে এরকম বিপদ ঘটার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। তিনি এই ঝুঁকির ভিত্তিতে ঢাকাকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করেছেন।

এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা-পুরান ঢাকা-মতিঝিল থেকে শ্যামলী পর্যন্ত এলাকা। ড. আফতাব আলম খান বলছেন, ঢাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি মাপার ক্ষেত্রে লিকুইফেকশনের ব্যাপারটি ১০ বছর আগেও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ফলে তখন বাংলাদেশের যে সাইসমিক জোনিং করা হয়েছে, সেখানে ঢাকাকে একটা মধ্যম ঝুঁকির সাইসমিক জোনের মধ্যে ফেলা হয়েছে। কিন্তু পরে যখন মাইক্রোজোনিং করে এ লিকুইফেকশনের ব্যাপারটি বেরিয়ে এলো, তখন এসব জোনে যেসব দালানকোঠা আগে থেকে গড়ে উঠেছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে এ ঝুঁকিটা কতটা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশের বিল্ডিং কোডে এ লিকুইফেকশনের বিষয়টি কতটা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।

সূত্র : ওয়েবসাইট


বিষয়:



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top