বাড়ছে ডেঙ্গু, সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে দ্বিগুণ রোগী

বৃষ্টি কমার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। গত ২৪ ঘণ্টায় ৮৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যা এই মাসে সর্বোচ্চ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান বলছে, এই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত ৩ হাজার ৯৭৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মারা গেছেন ৪৬ জন। আক্রান্তদের মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে ২ হাজার ৫০৩ এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় ১ হাজার ৪৭৫ জন। অর্থাৎ সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে প্রায় দ্বিগুণ রোগী আক্রান্ত হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, এই বছরের জানুয়ারি থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে ৫২১ জন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে ১ হাজার ৬৯ জন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে ৫২৮ জন, খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে ২০৬ জন, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে ৯০ জন, রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে ৫৫ জন, রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে ২৩ জন এবং সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে ১১ জন আছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, সিটি করপোরেশন অধীন এলাকাগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামে ৪৫ জন, ঢাকা উত্তরে ৫৭৮, ঢাকা দক্ষিণে ৮৪৭, গাজীপুরে ৩ এবং সাভার উপজেলায় ২ জন রোগী পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, মোট মৃত্যুর ২৮ জনই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায়। এছাড়া উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৫ জন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে ৪, ভেতরে ১, এবং বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে নারী ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং পুরুষ ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, এই বছরের জানুয়ারিতে ১ হাজার ৫৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯, মার্চে ৩১১, এপ্রিলে ৫০৪, মে’তে ৬৪৪, জুনে ৭৯৮ এবং জুলাইয়ে এখন পর্যন্ত ৩২৭ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়েছেন।
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকা এবং ঢাকার বাইরেও এডিস মশা নিয়ে কাজ করছি। চট্টগ্রাম, বরিশাল, বরগুনা, কক্সবাজার, গাজীপুর, চাঁদপুর, নরসিংদী ও মানিকগঞ্জে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ছে। মাঠপর্যায়ে ডেঙ্গুর বাহক মশার যে ঘনত্ব পাচ্ছি, অন্যান্য বছরের তুলনায় তা বেশি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডেঙ্গু এখন এমন একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেটিকে সরকার বা সিটি করপোরেশন একা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। পৃথিবীর কোনও দেশই জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়নি। জনগণকেও যে যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ বাড়ি ও বাড়ির আঙ্গিনায় এডিস মশার প্রজনন যেন না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে সঠিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে জলবায়ু তথা বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা সম্পৃক্ত। ২০০০ সাল থেকে যদি পরিসংখ্যান দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে গত ২৩ বছরে ধীরে ধীরে ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়েছে। অথচ ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাজধানীর বিত্তশালী এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল। এখন কিন্তু সেখানে সীমাবদ্ধ।’
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় পরিচ্ছন্ন অভিযান চালাতে হবে। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কিংবা জনপ্রতিনিধিদের এখানে সম্পৃক্ত করতে হবে। কাজটি প্রতিদিন করতে হবে, একদিন করেই বসে থাকলে হবে না। এটি জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া সম্ভব না। সিটি করপোরেশনের কাছে এত জনবল নেই। একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা দাঁড় করাতে হবে। সেটি মানুষকে সম্পৃক্ত করে করা সম্ভব।’
অন্যদিকে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘২০২৪ সালে বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় সন্তোষজনক অবস্থায় আছে। যদিও আমরা চাই, ডেঙ্গু পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে থাকুক। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু প্রত্যাশা করি না। কিন্তু পরিসংখ্যান বিবেচনায় আমরা এখনও ভালো অবস্থায় আছি।’
গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ‘ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ বিষয়ক জাতীয় কমিটি’ এর ২০২৪ সালের দ্বিতীয় সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, ‘বিগত বছরগুলোর চেয়ে এ বছর ঢাকা শহরের মানুষকে অধিক সচেতন করতে পেরেছি। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত সবাই কাজ করে যাচ্ছে। জেলা, উপজেলা ও পৌরসভা পর্যায়ের গঠিত কমিটিগুলো যাতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে সে বিষয়ে স্ব স্ব কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গত বছরের মতো এ বছরও দেশের সব জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারকে এ সংক্রান্ত পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার বিভাগের সব প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। যে অঞ্চলগুলোতে বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, আমরা সে অঞ্চলগুলোকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করছি। তাৎক্ষণিকভাবে হটস্পটে প্রতিনিধি গিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে বৃত্তান্ত নিয়ে আক্রান্ত রোগীর অঞ্চল চিহ্নিত করে দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছি।’
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: