মিথেন নিঃসরনে হুমকিতে নগর পরিবেশ
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকির মুখে থাকা পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ বাংলাদেশ। সমুদ্র-সমতল থেকে কম উচ্চতা, অধিক জনসংখ্যা, চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া, নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু ও পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলছে। যেসব গ্যাস গ্রিনহাউস প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে, সেগুলোকে গ্রিনহাউস গ্যাস বলা হয়।
গ্রিনহাউস প্রভাব সৃষ্টিকারী প্রধান গ্যাসগুলো হলো-কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস-অক্সাইড এবং ক্লোরোফ্লোরো কার্বন। এ গ্যাসগুলোর পরিমিত উপস্থিতি পৃথিবীর স্বাভাবিক অস্তিত্বের জন্য জরুরি। কিন্তু বর্ণহীন, স্বাদহীন ও গন্ধহীন অতিরিক্ত মিথেন গ্যাস পৃথিবীতে আসা সূর্যের তাপ ধরে রেখে বৈশ্বিক তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি করছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। গ্রিনহাউস গ্যাস মিথেনের অতিরিক্ত উপস্থিতির কারণে মানুষের শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বর্তমান যুগে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের অন্যতম একটি মাধ্যম হলো স্যাটেলাইট ডেটা। বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব, দূষণমাত্রা নির্ণয় ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা সম্ভব।
এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে সম্প্রতি প্যারিসের তথ্য বিশ্লেষণ সংস্থা কাইরোস সাস স্যাটেলাইট, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সেন্টিনেল-৫পি ও সেন্টিনেল ২ স্যাটেলাইট বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে মিথেন গ্যাসের ভূমিকাকে ভয়াবহ বলে চিহ্নিত করেছে। এ সংস্থা স্যাটেলাইট ডেটার মাধ্যমে বাংলাদেশের আকাশে বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাসের অস্তিত্ব লক্ষ করে। কাইরোস সাস স্যাটেলাইটের তথ্য অনুযায়ী, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মিথেন গ্যাস নিঃসরণকারী দেশের অন্যতম হলো বাংলাদেশ।’
বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষমতা কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে বেশি এবং মিথেন বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের তুলনায় ১০০ বছরে প্রায় ৩০ গুণ বেশি তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারে। গবেষণায় দেখা যায়, মিথেন গত দুই দশকে কার্বন ডাইঅক্সাইডের তুলনায় বায়ুমণ্ডলের ৮৪ গুণ বেশি ক্ষতি করেছে। জনপ্রিয় তথ্যসম্ভার উইকিপিডিয়া অনুসারে, জৈব যৌগের মধ্যে সরলতম জৈব মিথেন। বিজ্ঞানী বার্থেলো ১৮৫৭ সালে পরীক্ষাগারে সর্বপ্রথম কার্বন ও হাইড্রোজেন থেকে মিথেন নামে জৈব যৌগ তৈরি করেন।
মিথেন হচ্ছে একটি রাসায়নিক যৌগ, যার রাসায়নিক সংকেত CH₄। এর প্রতিটি অণুতে আছে এক পরমাণু কার্বন ও চার পরমাণু হাইড্রোজেন। এ গ্যাস বায়ুর চেয়ে হালকা এবং পানিতে সামান্য দ্রাব্য। বায়ুর সংস্পর্শে এলে এ গ্যাস জ্বলতে থাকে। মিথেন অ্যালকেন বা প্যারাফিন সমগোত্র শ্রেণির প্রথম যৌগ। মিথেনের আপেক্ষিক প্রাচুর্যতা এটিকে আকর্ষণীয় জ্বালানিতে পরিণত করেছে।
সাধারণ তাপমাত্রায় এটি গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে বিধায় উৎস থেকে মিথেন পরিবহণ করা কষ্টসাধ্য। বায়ুমণ্ডলীয় মিথেন একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস (প্রতি এককে কার্বন ডাইঅক্সাইড অপেক্ষা বেশি)। পেট্রোলিয়াম খনি থেকে নির্গত প্রাকৃতিক গ্যাসের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে (প্রায় ৮৫ শতাংশ) মিথেন উৎপন্ন হয়, অন্যদিকে কোল গ্যাসের আয়তন অনুসারে সেখানে প্রায় ৪০ শতাংশ মিথেন থাকতে পারে।
সম্প্রতি বিশ্বের কিছু আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশের আকাশে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি শনাক্ত করেছে। এ খবর করোনাকালীন সবার জন্যই উদ্বেগ ও গভীর ভাবনার একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অন্তত এক-চতুর্থাংশের জন্য মানবসৃষ্ট মিথেন নিঃসরণকে দায়ী করা হয়। জিএইচজি স্যাট তাদের হুগো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে শনাক্ত করেছে (এপ্রিল ২০২১) ঢাকা শহরের মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিল থেকে বিপুল পরিমাণে মিথেন গ্যাস নিঃসরণের তথ্য।
জিএইচজি স্যাট ধারণা করছে, এ ল্যান্ডফিল থেকে ঘণ্টায় প্রায় ৪০০০ কেজি মিথেন নিঃসরণ হয়। হিসাব করে দেখা যায়, ১ লাখ ৯০ হাজার গাড়ি যে পরিমাণ বায়ুদূষণ সৃষ্টি করে, তার সমপরিমাণ দূষণ সৃষ্টি করছে মাতুয়াইলের ১৮১ একর আয়তনের এ বিশাল বর্জ্যরে ডাম্পিং স্পট। তবে এ স্পটে জমা হওয়া দৈনিক ২৫০০ টন বর্জ্য থেকে কী পরিমাণ প্রকৃত মিথেন গ্যাস নির্গত হয়, এর সঠিক পরিসংখ্যান বাংলাদেশের কোনো সংস্থার কাছে নেই।
তবে দেশের আকাশে স্যাটেলাইট ডেটার মাধ্যমে মিথেনের যে আস্তরণ লক্ষ করা গেছে, তা শুধু মাতুয়াইল না হয়ে অন্য কোনো উৎস থেকেও হতে পারে। কারণ বাতাসের মাধ্যমে এটি অন্য কোনো উৎস থেকে আসতে পারে। পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন অবস্থা পর্যালোচনা করে বোঝা যায়, এ মিথেন গ্যাস একদিন বা একটি স্পট থেকে সৃষ্টি হয়নি।
এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। এছাড়া এ মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে হলে আমাদের ব্যক্তিপর্যায় থেকে শুরু করে সবাইকে সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশের আকাশে মিথেন গ্যাস বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন এবং তা প্রতিরোধের জন্য সময়মতো যথাযথ ব্যবস্থা নিতে না পারলে সমগ্র জাতি স্বাস্থ্য ও পরিবেশ ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মূলত মিথেন গ্যাস নিঃসরণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় ধানখেত, বর্জ্যরে ডাম্পিং স্পট, প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইনে ফাটল ও কয়লা পোড়ানোসহ বিভিন্ন উৎসকে। এছাড়া জলাশয়, সমুদ্র, কৃষিজমি, বনভূমি কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকেও মিথেন জমা হতে পারে। দেশের প্রায় সব সিটি করপোরেশন এলাকায় ময়লা-আবর্জনাগুলো অনেক ডাম্পিং স্পটে উন্মুক্তভাবে পোড়ানো হয়; ফলে এটিও মিথেনের একটি বড় উৎস হতে পারে।
অন্যদিকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, কুষ্টিয়া ও চট্টগ্রামের ল্যান্ডফিল থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদনের প্রজেক্ট বিদ্যমান, যা মূলত মিথেন থেকেই সৃষ্ট। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বায়োগ্যাস মানুষের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে। বায়োগ্যাস মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় শক্তির আধার হয়ে উঠছে।
বায়োগ্যাসের মধ্যে ৫৫ থেকে ৬৫ শতাংশ মিথেন গ্যাস থাকে। বাংলাদেশের বর্জ্যরে ডাম্পিং সাইটগুলোয় মূলত কোনো ধরনের স্যানিটারি ল্যান্ডফিল না থাকায় বাতাসে মিথেন গ্যাস বৃদ্ধির পরিমাণ লক্ষণীয়। স্যানিটারি ল্যান্ডফিলে বর্জ্য থেকে পানি পৃথক করার ফলে আবর্জনা থেকে মিথেনের পরিমাণ কমে যায়; কিন্তু এটি ব্যয়সাপেক্ষ বলে দেশে এ পদ্ধতি এখনো পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়নি।
অন্যদিকে করোনাজনিত বর্জ্যসামগ্রীর যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের হুমকিতে এখন সমগ্র বাংলাদেশ। কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষা পেতে বাংলাদেশের মানুষ যতটা সচেতন, ঠিক ততটাই অসচেতন এ ধরনের বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনায়। করোনাকালীন সুরক্ষার জন্য ব্যবহারকৃত বিভিন্ন সামগ্রী যেমন : মাস্ক, গ্লাভস, ফেসশিল্ড, শু ও হেড কভার, পিপিই, স্যানিটাইজার ও হ্যান্ড ওয়াশের প্লাস্টিক বোতল ইত্যাদির বিরাট এক অংশ রাস্তাঘাটে ও যত্রতত্র উন্মুক্ত স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এজন্য করোনাজনিত বর্জ্যসামগ্রীর যথাযথ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হচ্ছে না।
পূর্ববর্তী এক হিসাবে দেখা যায়, দেশে করোনা শুরুর পর ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১৪ হাজার ৫০০ টন মেডিকেল বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার অধিকাংশ কোভিড-১৯ সুরক্ষাসামগ্রী। কিন্তু এসব বর্জ্য কতটুকু পরিবেশসম্মতভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে তা অজানা। কারণ দেশের অধিকাংশ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিবেশসম্মতভাবে মেডিকেল বর্জ্য যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয় না।
ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালীন যেসব মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে, তার ৯০.৪ শতাংশ যথাযথ ব্যবস্থাপনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এছাড়া গৃহস্থালি বর্জ্যরে সঙ্গে মেডিকেল বর্জ্যরে মিশ্রণের ফলে শহরের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কোভিড সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহারের ফলে করোনাভাইরাস থেকে আমরা সাময়িক রেহাই পেলেও করোনাজনিত এসব বর্জ্যসামগ্রী অনিয়ন্ত্রিত ও যত্রতত্র নিক্ষেপের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পরিবেশ দূষণের কবল থেকে সহজে রেহাই পাবে না। সুতরাং এসব বর্জ্য এবং আকাশে মিথেন গ্যাসের বিষয়টি এখনই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে দেশে মারাত্মক সংক্রমণ ঝুঁকি ও অ্যাসিড বৃষ্টিসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
এছাড়া জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসহ ঝুঁকিতে পড়তে পারে মানুষের স্বাস্থ্য। বর্জ্যরে সব উৎস চিহ্নিত করে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। এজন্য আমাদের এখন থেকেই টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: