ঢাকা শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪, ২১শে আষাঢ় ১৪৩১

কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য মিশছে হালদায়, মারা যাচ্ছে মাছ-ডলফিন


প্রকাশিত:
২ জুলাই ২০২৪ ১৩:২১

আপডেট:
৫ জুলাই ২০২৪ ০২:৩৫


দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতে গত এক সপ্তাহে পাঁচটি বড় মা মাছ ও একটি ডলফিন মরে ভেসে উঠেছে। সর্বশেষ রবিবার দুপুরে নদীর রাউজান অংশের পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের আজিমের ঘাটে আরও একটি মা কাতলা মাছ মরে ভেসে ওঠে। মাছটির ওজন ১৯ কেজি ৩০০ গ্রাম। একের পর এক মাছ মারা যাওয়াকে অস্বাভাবিক ঘটনা বলছেন হালদা নদী গবেষকরা। এসব মাছ এবং ডলফিনের মৃত্যুর কারণ জানতে রবিবার পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা মৎস্য অধিদফতর।

জেলা মৎস্য অধিদফতর ও হালদার স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত শুক্রবার দুপুরে হাটহাজারী উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের কুমারখালী ঘাট এলাকা দিয়ে ভেসে যাওয়ার সময় নদীর স্বেচ্ছাসেবকেরা দুটি মরা মা কাতলা মাছ ডাঙায় তুলে আনেন। বিকালে উপজেলা মৎস্য অধিদফতর, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবীরা মিলে একটি মাছ মাটি চাপা দেন। অন্যটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে পাঠানো হয়।

গত মঙ্গলবার বিকালে নদীর হাটহাজারী অংশের গড়দোয়ারা সিপাহীঘাট এলাকা থেকে ৯০ কেজি ওজনের একটি বড় ডলফিন মরে ভেসে ওঠে। গত বুধবার বিকালে রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের বাকর আলী চৌধুরী ঘাট এলাকায় একটি ১২ কেজি ওজনের মরা রুই মাছ ভেসে ওঠে। এক সপ্তাহ আগে একই ঘাটে মরা কাতলা মাছ ভেসে এলে সেটি ডাঙায় তুলে মাটি চাপা দেওয়া হয়।

একের পর এক কেন মাছ মারা যাচ্ছে জানতে চাইলে হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত এক সপ্তাহে হালদা নদীতে পাঁচটি মা মাছ ও একটি ডলফিনের মৃত্যু অশনি সংকেত। বর্তমানে নদীদূষণের চিত্র ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এর পাশাপাশি হালদা মৎস্য প্রজননক্ষেত্র ধ্বংসের জন্য দায়ী মানবসৃষ্ট দূষণ।’

হালদা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত অসংখ্য শাখা খাল আছে জানিয়ে ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এর মধ্যে ১৬টি শাখা খাল আছে সবচেয়ে বড়। যেগুলো দিয়ে প্রতিনিয়ত কলকারখানার নানা দূষিত বর্জ্য হালদায় পড়ছে। বিশেষ করে মদুনাঘাট থেকে মোহরা পর্যন্ত তিনটি খাল দূষণ ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। কাটাখালী খাল, ব্রাহ্মণশাহী খাল ও খন্দকিয়া খাল হয়ে দূষিত বর্জ্য হালদায় এসে পড়ছে। অনেকগুলো কলকারখানায় ব্যবহৃত কেমিক্যালযুক্ত পানি ও বর্জ্য নদীতে সরাসরি আসছে। সেইসঙ্গে ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য, শিল্পবর্জ্য, পোল্ট্রিবর্জ্য, গৃহস্থালী ও মানববর্জ্যও এসে পড়ছে নদীতে। এ ছাড়া হালদা এবং শাখা খালে অবৈধভাবে জাল, বড়শি ও বিষ দিয়ে মাছ নিধন এবং অবৈধ বালু উত্তোলনের প্রভাব পড়েছে। এগুলোও মাছের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।’

এই গবেষক আরও বলেন, ‘গত শুক্রবার হালদার মদুনাঘাটের কাটাখালী অংশের পানির নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে ৩ দশমিক ৬ মিলিগ্রামে নেমে এসেছে। এর আদর্শ মান ৫ মিলিগ্রাম। পানিতে মুক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের মান স্বাভাবিকের (প্রতি লিটারে ৫-১০ মিলিগ্রাম) তুলনায় বেড়ে প্রতি লিটারে ২০ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। আবার পিএইচের মান স্বাভাবিক সর্বনিম্ন সীমার (৬ দশমিক ৫) একদম কাছাকাছি (৬ দশমিক ৬)। যা মাছের মৃত্যুর জন্য দায়ী।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘হতাশাজনক বিষয় হলো ২০১৬ সালের পর হালদা নদীতে এ বছর সবচেয়ে কম পরিমাণ ডিম দিয়েছে মাছ। এখন আবার শুরু হয়েছে মা মাছের মৃত্যু। এটি নদীদূষণের ফলে হচ্ছে।’

হালদার শাখা খালগুলো দূষণের কারণে পরিবেশগত বিপর্যয় ও মাছের মৃত্যু বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হালদা রক্ষার জন্য বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। এই বিপর্যয় রোধে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দ্রুত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কারণ উদঘাটনের দাবি জানাচ্ছি।’

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘হালদায় এক সপ্তাহে পাঁচটি মা মাছ এবং একটি ডলফিন মারা যাওয়ার বিষয়টি উদ্বেগের। কেন এক সপ্তাহে এতগুলো মা মাছ এবং ডলফিন মারা গেছে, তার কারণ জানতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে হাটহাজারী উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ফারুক ময়েদুজ্জামানকে। কমিটিকে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, হালদায় মাছ ও ডলফিনের মৃত্যুর কারণ তদন্তে পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সংস্থাটি। গত এক সপ্তাহ ধরে গঠিত কমিটি কাজ করছে।

২০২০ সালে হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। মুজিববর্ষের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশগত মান উন্নয়নের মাধ্যমে রুই জাতীয় মাছের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের আবাসস্থল সংরক্ষণের লক্ষ্যে খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় ও মানিকছড়ি উপজেলা, চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি, রাউজান, হাটহাজারী উপজেলা এবং পাঁচলাইশ থানার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হালদা নদী এবং নদী তীরবর্তী ৯৩ হাজার ৬১২টি দাগের ২৩ হাজার ৪২২ একর জমিকে বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সরকারের গেজেট অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ এলাকায় ১২টি শর্ত কার্যকরের কথা বলা হয়। যার মধ্যে একটি শর্ত হলো নদীর চার পাশের বসতবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পয়োবর্জ্য ও তরলবর্জ্য নির্গমন করা যাবে না। তবে এখন পর্যন্ত ১২টি শর্ত বাস্তবায়ন হয়নি।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা। এই নদী হলো রুইসহ বিভিন্ন প্রজাতির কার্প মাছের অবাধ বিচরণ কেন্দ্র। এখানে প্রতি বছর এপ্রিল থেকে জুন মাসে মা মাছ ডিম ছাড়ে।

হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরি সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত হালদায় ৪১টি বিপন্ন প্রজাতির গাঙ্গেয় ডলফিন মারা গেছে। ৪০তম ডলফিনের মৃত্যু হয়েছিল ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর। একই সময়ে মারা গেছে ৩০টির মতো মা মাছ। এর মধ্যে অধিকাংশ ডলফিন এবং মা মাছ আঘাত, শ্বাসকষ্ট ও দূষণের কারণে মৃত্যু হয়েছে বলে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেহালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরি।


বিষয়:



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top