ঢাকায় কাঁচের ভবনগুলো কি আসলেই তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে?

ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকায় নতুন যে ভবনগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে তার বেশিরভাগই পুরোপুরি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
এসব ভবনের বড় একটি অংশেই এমন কাঁচ ব্যবহার করা হয় যাতে বাইরের বাতাস-শব্দ ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে।
ফলে ভবন শীতল রাখতে বেড়ে যায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার।
আর এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকেই তাপ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন নগরবিদরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “উন্মুক্ত এবং উপযুক্ত নয় এমন কাঁচ দিয়ে ভবন নির্মাণের ফলে বাড়ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার।”
“স্বাভাবিকভাবেই উচ্চ প্রযুক্তির কাঁচ না লাগালে ভবন অতিরিক্ত তাপ ক্ষরণ করে কিংবা শোষণ করে। ফলে ভবনের ভেতরের তাপমাত্রা অযাচিত পরিমাণে বেড়ে যায়,” যোগ করেন মি. হাবিব।
ভবনে জ্বালানি ও বিদ্যুতের ব্যবহার ও এর কার্যকারিতা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘এনার্জি এন্ড বিল্ডিংসে’ ২০২২ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভবন শীতলীকরণের নেতিবাচক প্রভাবের কথা উল্লেখ করে প্রাকৃতিক বায়ুচলাচলের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
এতে জাপানের টোকিও শহরের বাণিজ্যিক ভবনের ওপর পরিচালিত অপর একটি গবেষণার ফলাফলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই গবেষণায় দেখা গেছে কর্মব্যস্ত দিনগুলোতে আধুনিক বাণিজ্যিক ভবনগুলোয় ব্যবহৃত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র থেকে নির্গত বাতাস সংলগ্ন এলাকার তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়িয়ে তুলেছে।
তাইপের আবাসিক এলাকায় করা অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভবনগুলোর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আশেপাশে এসি থেকে নির্গত উষ্ণ বাতাসের কারণে তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। এর ফলে ভবনগুলো শীতল করতে এসি'র জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়তি বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে, প্রয়োজন হচ্ছে বাড়তি এসিরও। এটিকে একটি দুষ্টচক্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে উক্ত গবেষণায়।
ছবির ক্যাপশান,বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, আধুনিক কাঁচের ভবনগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শেডিং ব্যবস্থা না থাকায় সরসরি সূর্যের আলো পড়ে ভবনের ভেতরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। পাশাপাশি, কাঁচের দেয়ালে আলো প্রতিফলিত হয়ে আশপাশের তাপমাত্রাও বাড়িয়ে তোলে।
শুধু তাই নয়, তাপমাত্রা কমাতে ভবনের ভেতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বাড়তি ব্যবহার ও বাড়তি বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। এসব যন্ত্র থেকে নির্গত উষ্ণ বাতাসও পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এতে ‘হিট আইল্যান্ড’ তৈরি হচ্ছে উল্লেখ করে একে ‘বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা’ বলছেন নগরবিদরা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “একটা এসি যে এনার্জি খরচ করে, তাতে ২৫ থেকে ৩০টা ফ্যান চলতে পারে। আবার নিজের আরামের জন্য বাড়তি তাপ বাইরে দেয়া হচ্ছে। এতে এনার্জির বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।”
সব কাঁচের ভবনই কি তাপমাত্রা বাড়ায়?
যে কয়টি কারণে ঢাকায় তাপমাত্রা বাড়ছে তারমধ্যে ‘কাঁচের ভবন একটি’ বলে উল্লেখ করেন মি. খান।
তবে ‘কাঁচের ভবন মানেই খারাপ কিছু নয়’ বরং নির্মাণের সময় ‘কোন ধরনের কাঁচ, কীভাবে ব্যবহার হছে সেটার ওপর (তাপ) নির্ভর করে’ বলে জানান স্থপতি ইকবাল হাবিব।
তার মতে “উন্মুক্ত এবং উপযুক্ত নয় এমন কাঁচ” দিয়ে ভবন নির্মাণের কারণে বাড়ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার। ফলে বাড়ছে তাপমাত্রা।
অর্থাৎ কাঁচ দিয়ে ভবন নির্মাণ করা হলেও বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নেয়া হলে এটি বাড়তি তাপ উৎপাদন থেকে বিরত থাকে। যেমন ‘শেডিং’ ব্যবস্থা।
“কাঁচ দিয়ে কোনো ভবন নির্মাণের সময় যদি এটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয় যাতে করে বাইরের কাঁচের ওপর সূর্যের আলো সরাসরি না পড়ে তবে এটি বাড়তি তাপ উৎপাদন করবে না। ফলে ভবনের ভেতর গরমও বাড়বে না,” জানাচ্ছেন ভবন বিশেষজ্ঞরা।
কিন্তু খুব কম সময়ই ভবন নির্মাণের সময় এই বিষয়টি খেয়াল রাখা হয়। বরং শেডিং ব্যবস্থা না থাকায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে নগরীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে তুলছে বলে জানান ভবন বিশেষজ্ঞরা।
আবার অনেক জায়গায় কাঁচগুলো খোলা রাখার ব্যবস্থাও থাকে না। ফলে বাধ্যতামূলকভাবেই ঝুঁকতে হয় ‘শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের’ দিকে।
ভবনের এই নকশা বাংলাদেশের আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত না বলে মনে করেন পরিকল্পনাবিদ মি. খান।
তিনি বলেন, “শীতপ্রধান দেশে এ ধরনের নকশার কারণে তাপমাত্রা বাড়ে। আর শীত কমলে তাদের লাভ হয়। কিন্তু এখানে তাদের অনুসরণ করা পশ্চাৎপদতা।”
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণকে অনেকে ‘প্রেস্টিজ কনসার্ন’ হিসেবে দেখেন বলে মনে করেন মি. হাবিব। বলেন, “শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ওপর ভরসা করে ভবন নির্মাণের প্রবণতাকে অনেকে সামর্থ্য হিসেবে দেখেন। এমনকি সরকারি ভবনগুলোতেও ইদানিং হরহামেশাই দেখা যায় কাঁচের ব্যবহার।”
তার মতে, যখন এটা ‘জাতীয় দর্শন বা নগর-দর্শনে’ পরিণত হয়, তখন তা নগরীকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: