ঢাকা শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

দেবতাখুমে এক প্রহর


প্রকাশিত:
৫ জুলাই ২০২১ ০৬:১১

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:২১

দেবতারা নাকি কেবল স্বর্গেই থাকেন, মর্তে তাদের দেখা মেলে না। এতোকাল এমনটাই জেনে এসেছিলাম। তবে পাহাড়ের বুকে নির্জনে গেলে নাকি মাঝে মাঝে দেবতারা মর্তে যেখানে আসন গেড়ে বসেন সেই স্থানের দেখা পাওয়া যায়। আমি আবার এই ধরনের স্থানে যাওয়ার তক্কে তক্কে থাকি। তাই এই ডিসেম্বরেই হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে দেবতা দেখতে যাব। হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে কোথাও চলে যাওয়ার আলাদা একটা আনন্দ আছে। এর আগে যতবার হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে কোথাও গিয়েছি, স্মৃতিচারণ করতে গেলে ঘুরে ফিরে ঐ জায়গাগুলোর কথাই কেবল মনে পড়ে।       

বলছিলাম বান্দরবানের দেবতাখুমের কথা। বান্দরবানে অনেক জানা-অজানা খুমের কথা আমরা কম বেশ সবাই জানি যেমন- নাফাখুম, অমিয়াখুম, সাত-ভাই খুম ইত্যাদি।

স্থানীয় অধিবাসীরা খুম বলতে জলপ্রপাতকে বোঝায়। বান্দরবানের গহীনে লুকিয়ে থাকা নৈসর্গিক এই খুমগুলো দেখতে প্রতিনিয়তই মানুষ সেখানে যায়। তবে যেতে যতটা শুনতে সহজ মনে হয়, ততোটা কিন্তু নয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাহাড়ি বন্ধুর পথ দিয়ে হেঁটে, আছাড় খেতে খেতে, ক্লান্ত হয়ে সেই খুমগুলোর দেখা মেলে। এমনই পাহাড়ি রাস্তা আর ঝিরিপথ পাড়ি দিয়ে দেবতাখুমের দেখা মেলে।  পাহাড়ের মানুষের বিশ্বাস যে এই খুমে জ্বীন থাকে যাদের তারা বলে দেবতা। বান্দরবান শহর থেকে ১৯ কিঃমিঃ দূরে রোয়াংছড়িতে এই দেবতাখুম অবস্থিত। কেউ একদিনের ট্যুরের জন্য দেবতাখুমকে নিমিষেই বেছে নিতে পারেন। যেখানে ভেলায় করে দেখে আসতে পারবেন স্বর্গের পথ আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে সাথে দেবতাও।      

কক্সবাজার থেকে আমরা তিনজন সহকর্মী বন্ধু বিকেলেই রওনা করি বান্দরবানের উদ্দেশ্যে কারণ রাতে কক্সবাজার থেকে বান্দরবানে যাওয়ার কোন গাড়ি নেই। তাছাড়া ঢাকা থেকে একটা ট্র্যাভেল গ্রুপ আসবে। উদ্দেশ্য তাদের সাথে বান্দরবানে একত্রিত হয়ে দেবতাখুমে যাওয়া। অফিস শেষে বিকেলে কক্সবাজার থেকে রওয়ানা দেওয়ায় রাত ১০ টা নাগাদ পৌঁছে যাই বান্দরবান শহরে। এরপর ছোট্ট একটা গেস্ট হাউসে উঠি শুধু রাতটা পার করার জন্য। গেস্ট হাউসের রুমে ঢুকে মনে হল ৮০’র দশকের কোন একটা সিনেমার স্টেজে ঢুকে গেছি বুঝি। বড় বড় সেগুন কাঠের খাট আর বড় কাঠের আলনা। নোনা ধরা দেয়াল থেকে চুন সুরকির গন্ধ আসছিল। তবে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল আমাদের ১২ ইঞ্চির ভিনটেজ একটা টেলিভিশন। যদিও ওটা চালানোর দুঃসাহস আমরা কেউই করিনি।       

সারাদিন অফিস আর জার্নি করে পাশের একটা হোটেল থেকে খেয়ে এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই একেবারে ঘুমে কাদা হয়ে গেলাম। পরদিন খুব ভোরে নির্দিষ্ট চান্দের গাড়ি গেস্ট হাউসের সামনে এসে উপস্থিত। ওদিকে ঢাকার বন্ধুরাও হাজির। পরিচয় পর্ব শেষে এখন যাত্রা শুরুর পালা। গাড়িতে সবাই জবুথুবু হয়ে বসে দিলাম পাড়ি রোয়াংছড়ি বাজারের উদ্দেশ্যে। মূলত রোয়াংছড়ি বাজার থেকে কচ্ছপতলি আর্মি ক্যাম্প থেকে অনুমুতি নিয়ে সেখান থেকে ট্রেক করেই দেবতাখুম যাওয়ার নিয়ম।

আমাদের চান্দের গাড়ি কুয়াশার চাদর ভেদ করে সামনের দিকে এগুতে থাকল। পথিমধ্যে সবাই সেরে নিলাম সকালের নাস্তাটাও। খুব কুয়াশা থাকায় রোয়াংছড়ির আঁকাবাঁকা পথগুলো, পথের ধারের পাহাড়গুলো খুব একটা দেখা যাচ্ছিল না। একটু রোদের জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করছিল। আস্তে আস্তে ঘণ্টা খানেক পর একটু একটু করে সূর্যের উঁকিঝুঁকি টের পাচ্ছিলাম কিন্তু বেলা তখনও হয়নি। বেলা হতে হতে আমরা কচ্ছপতলি এসে উপস্থিত। তড়িঘড়ি করে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন ট্রেকিং স্যান্ডেল, মোবাইল সাথে নেওয়ার জন্য ছোট্ট একটা ওয়াটার প্রুফ ব্যাগ কিনে বাকি ব্যাগপ্যাক স্থানীয় একটা দোকানে রেখে নেমে পরলাম পাহাড়ি রাস্তায়। সাথের গাইড দাদা আর গ্রুপের কর্তা ভাই বারবার আমাদের তাড়া দিচ্ছিলেন দ্রুত এগোনোর  জন্য। কারণ শুক্রবার মানে ছুটির দিনে ভেলার জন্য খুব বেগ পেতে হয়। খুব ভীড় থাকে ভেলার জন্য এবং অনেকক্ষণ অপেক্ষা করা লাগে। যারা যাওয়ার কথা ভাবছেন তাদের উদ্দেশ্যে, পারলে ছুটির দিন এড়িয়ে অন্যদিনকে দেবতাখুমে যাওয়ার জন্য বেছে নিতে পারেন এই ভীড় এড়ানোর জন্য।        

পাহাড়ি ঝিরিপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আর মুগ্ধতায় বারবার চোখ মুদছি। এর মাঝে সূর্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার কিরণ ছড়িয়ে নিজ উপস্থিতি জানান দিতে, কিন্তু সুউচ্চ পাহারগুলোকে পুরোপুরি বাগে আনতে পারছে না। যার ফলে পাহাড়ের গায়ে সূর্যের কিরণ ধাক্কা খেয়ে আলো-আঁধারের এক নৈসর্গিক রুপ ধারণ করেছে। আলো- আঁধারের এই যুগলবন্দী যেন যাত্রায় ষোলকলা পূর্ণতা দিয়েছে। মাঝে মাঝে হাসির কলরোল আর হাঁটার শব্দ ছাড়া সারাক্ষণই বয়ে চলা ঝিরিপথের শব্দ পাচ্ছিলাম। কেমন এক প্রশান্তি আর স্নিগ্ধতায় দেহ-আত্মা মিলেমিশে একাকার। এবরো-থেবরো, পিচ্ছিল পথ এই প্রশান্তিতে যে কিঞ্চিৎ ব্যাঘাত সৃষ্টি করেনি তা কিন্তু একবারেই না। দেবতাখুমের ট্রেইল যেমন সুন্দর ঠিক তেমনি ভয়ংকর। পিচ্ছিল, পাথুরে পথ দেখে দেখে পা না ফেললে বিপদে পরে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। 

পাহাড়ি বন্ধুর ঝিরিপথ আর দুইবার খেয়া পারাপার হয়ে অবশেষে এসে পৌঁছুলাম খুমে ঢোকার প্রবেশদ্বার শিলবাঁধা পাড়ায়। এখান থেকেই ভেলা বা নৌকা নিয়ে খুমের ভেতর প্রবেশ করতে হয়। খুমের পানির গভীরতা প্রায় ৫০-৭০ ফুট আর দৈর্ঘ্যে প্রায় ৬০০ ফুটের মতো। এডভেঞ্চারপ্রেমীরা বারতি এডভেঞ্চারের জন্য ভেলায় যেতেই আগ্রহী হন। তবে সবাই আবার ভেলায় ভেসে যেতে মনোবল পান না। তাতে অবশ্য সমস্যা নেই কারণ বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে নৌকা থাকে। আমি আবার ভেলা, কায়াকিং, লাফঝাঁপে বেজায় আগ্রহী কিনা তাই ভেলাতে যব বলেই মনঃস্থির করলাম । কিছু সময় অপেক্ষা করে যুতসই একটা রঙ্গিন ভেলা মিলল। সাথে নিয়ে নিলাম গাইড দাদাকে। যতই সাহসী হই না একা ভেলা চালিয়ে যাওয়ার মতো সাহস করতে পারিনি।  

দিলাম খুমের ভেতর ভেলা ভাসিয়ে। একটু একটু করে ভেতরে যাচ্ছি আর সৌন্দর্যের ভয়াল দৃশ্য দেখে তব্দা খেয়ে যাচ্ছি । বেশি অবাক হলাম খুমের পানির রঙ দেখে। নীলাভ বর্ণের পানি। আকাশ যেন তার এক ছটাক নীল খুমের পানিতে মিশিয়ে দিয়ে গেছে। চারপাশ নিস্তব্ধ, নীরবতায় আচ্ছন্ন। যেন এক ভুতুড়ে পরিবেশ। পানির ফোঁটা ফোঁটা শব্দ পরিবেশটা আরও ভুতুড়ে করে দিচ্ছিল। পাহাড় বেয়ে উপরের দিকে তাকালে সবুজ গাছপালার দেখা মেলে। কালো কালো পাথুরে পাহাড়ের ভেতরের অলিগলি পথ দিয়ে ভেলা সামনের দিকে এগুচ্ছে। কিছু কিছু স্থানে আবার সূর্যের আলোও এসে পৌঁছোয় না। নীলাভ শীতল পানি ধরে বয়ে যেতে যেতে পেয়ে গেলাম পাথরের জলপ্রপাত। বারবার মনে হচ্ছিল, স্বর্গের পথ বুঝি এমনি হয়। দেবতা বুঝি এক্ষুনি এসে হাঁক দিয়ে বলবেন- “বল, কি চাস?” আমি বোকা, অধম মনে মনে উত্তর কি দিব তাই ভাবছিলাম। একসময় ভেলা থেকে নেমে পা রাখলাম কালো কালো পাথরের সমারোহে। কারন এর পরে আর যাওয়ার নিয়ম নেই। হিম শীতল পানি, জলপ্রপাতের শব্দ, চারপাশের পাহাড়ের কালো দেয়াল সব মিলিয়ে মহাজাগতিক একটা অভিজ্ঞতার রচনা করছিল এবং তখনি দেবতাখুমের নামকরনের সার্থকতা যেন খুঁজে পেলাম।     

কিছুক্ষণ নির্বাক বসে রইলাম পাথরের উপর, ইচ্ছেমত জলকেলি করলাম নিজের সাথে। ৩০ মিনিট থেকে ফিরতি পথ ধরলাম। ফিরতি পথে ভেলা পাওয়া নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছে যদিও। ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলাম খুমের ভেতর থেকে। কনকনে ঠাণ্ডা, কুয়াশা, শীতল পানি সব মিলিয়ে শীতে সাপটে রইলাম কিছুক্ষণ। পাড়ে এসে দেখি কেউ কেউ আগুন জালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। আমিও গিয়ে আগুনের ধাঁরে বসে পরলাম।

এখন ফেরার পালা। সেই পাহাড়ি ঝিরিপথ ধরেই ফিরতে হবে। কারো কোন ক্লান্তি নেই, ক্ষুধা নেই। ফিরতে ফিরতে বেলা বেশ পড়ে এলো। কক্সবাজারগামী শেষ বাসটা ধরার প্রথম দিকে যেই তাড়া ছিল সেই তাড়াও এখন আর নেই। মনে হচ্ছিল, এই পথ ধরে যাচ্ছি যাই না মন্দ কি বরং এই পথের শেষ না হোক। তারাশংকরের কবি বইয়ের কয়েকটা চরণ ফেরার পথে বারবার মনে মনে আওরাচ্ছিলাম-

“এই খেদ মোর মনে
ভালবেসে মিটল না আশ- কুলাল না এ জীবনে।
হায়, জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?”

সৈয়দা তাহসিনা হৃদিতা
UNV ইউএনভি চাইল্ড প্রোটেকশন অফিসার, UNICEF, কক্সবাজার

সূত্রঃ মানবজমিন


বিষয়:



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top