ঢাকা শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে NGO -এর ভূমিকা


প্রকাশিত:
১৯ অক্টোবর ২০১৯ ০০:৫৪

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৫৯

ছবি: গুগল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়কাল থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে NGO একটি আলোচিত এবং আলোড়ন বিষয়। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে দারিদ্রতাকে পুঁজি করে NGO কার্যক্রমের বিকাশ ঘটে। তাছাড়া সরকারি সংস্থাসমূহ যখন দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে ব্য্র্থ হচ্ছিল তখনই দাতাদেশগুলোর উদ্যোগে এবং কিছু দেশীয় ব্যক্তি বর্গের উদ্যোগে সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রম শুরু করা হয়। বাংলাদেশের ন্যায় কৃষিভিত্তিক দেশের পল্লী উন্নয়নে এই NGO দের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এরা গ্রামের জনমূল পর্যায়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এ নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের দেশী ও বিদেশি NGOর সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে।

পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনে NGO এর ভূমিকাঃ

কৃষি উন্নয়নঃ বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। গ্রামীণ দরিদ্র জনসংখ্যার অধিকাংশইই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষির উন্নয়ন হলে দরিদ্রতা কিছুটা লাঘব হবে। কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন NGO কৃষি ঋণ দিচ্ছে দারিদ্র জনসাধারণকে। এতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দরিদ্রতা বিমোচনে এগিয়ে যাচ্ছে।

ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পায়নঃ দেশে কর্মরত NGO গুলো দরিদ্র জনগনকে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পায়নের জন্য ঋণ দিচ্ছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পায়নের ফলে দারিদ্রতা দূরীভূত হচ্ছে এবং পল্লীর উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে।

মানব সম্পদ উন্নয়নঃ মানবিক উন্নয়ন, ব্যক্তির মর্যাদা, ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীলতার বিকাশ এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোর সম্পর্কে, শোষণ ও আধিপত্য সম্পর্কে বিষয়ে বিশ্লেষণমূখী জ্ঞানার্জনে সহায়তার মাধ্যমে মানুষের নিজের করণীয় আবিষ্কার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে কার্যকর ভাবে উদ্যোগী করে তোলে। পুরানো কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও জীবন বিমুখী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে সমাজ ও সমস্যাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে বাস্তব ও রাজনৈতিক ধ্যান ধারণায় উদ্ধুত করার লক্ষ্যে NGO সমূহের প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য।

মূলধন সরবরাহঃ বিভিন্ন NGO মূলধন গঠনের উপর জোর দিয়েছে। মূলধনের অভাবে গ্রামের দরিদ্র জনগন কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি কাজ করতে পারছে না। NGO গুলো কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্য করার জন্য দরিদ্র জনগণকে মূলধন সরবরাহ করছে। যার ফলে দরিদ্র জনগণ মূলধন বিনিয়োগ করে দারিদ্রতা দূরীকরণে সক্ষম হচ্ছে।

কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বৃদ্ধিঃ আমাদের দারিদ্রতার অন্যতম কারণ হলো বেকারত্ব। NGO গুলো বেকারত্ব নিরসন কল্পে তথা কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বৃদ্ধির জন্য ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। NGO গুলোর ঋণ সহায়তা কার্যক্রম গুলো হলো, ভূমিহীনদের সেচ প্রকল্প, খাল ও পুকুরে মৎস্য চাষ, উপকূল এলাকার মৎস্য আহরণ, তাঁত শিল্প, ভূমিহীন বর্গাচাষীদের জন্য কৃষি উপকরণ বিতরণ প্রভৃতি। এছাড়া শত শত নারী পুরুষকে গবাদিপশু, হাঁস মুরগির টিকাদান ও চিকিৎসা, বৃক্ষ-নার্সারী প্রভৃতি, শিক্ষা ও ঋণ দান করে দারিদ্র বিমোচনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

মহিলা সমাজের উন্নয়নঃ বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক হলো মহিলা। কাজেই মহিলাদের অবস্থার উন্নয়ন ছাড়া দেশ থেকে দারিদ্রতা দূর করা যাবে না। এ লক্ষ্যে NGO গুলো নারী শিক্ষার প্রসার ও মহিলাদের কর্মসংস্থানের জন্য হাসমুরগি পালন, গরু ছাগল পালন, রেশম চাষ প্রকল্প মৌমাছি পালন, ধানভাঙা, চিড়া-মুড়ি তৈরি, কুটির শিল্প ও হস্তশিল্প যেমনঃ বাঁশ, বেত, মাটি ও কাঠের কাজ প্রভৃতি সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখে/রাখছে।

শিক্ষা বিস্তারঃ দেশের দারিদ্রতা বিমোচনের লক্ষ্যে NGO গুলো শিক্ষা বিস্তার করে আসছে। দারিদ্রতা দূর করতে হলে প্রথিমে অজ্ঞতা ও নিরক্ষরতা দূর করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থা সম্প্রসারণে ব্রাক, ইউনিসেফ, ফেয়ার প্রভৃতি NGO গুলো স্কুল, ঘর নির্মাণ, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বই, খাতা, কলম বিতরণ করে গ্রামীণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক বর্তমানে শিক্ষার উন্নয়নের জন্য উচ্চ শিক্ষা, ঋণ ও বৃত্তির ব্যবস্থা চালু করেছে। এছাড়া NGO গুলোর রয়েছে বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচি যার মাধ্যমে বয়স্কদের দেয়া হচ্ছে শিক্ষার আলো।

বনায়নঃ NGO সংস্থাসমূহ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির মাধ্যমে পথে প্রান্তরে বিপুল পরিমাণ বৃক্ষরোপণ করছে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে তারা সরকারের জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ও বীড়াট ভূমিকা রাখছে।

ত্রাণ ও পুর্নবাসন কার্যঃ প্রাকৃতিক দুর্যোগে NGO সমূহ তাদের যথাসাধ্য সম্পদ নিয়ে ত্রাণ ও পূর্নবাসনে এগিয়ে আসে। এছাড়াও বন্যা, দুর্গত ও উপকূলীয় অঞ্চলে সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণের মাধ্যমে আশ্রয়হীন মানুষকে দেওয়া হয়েছে আপাতকালীন আশ্রয়ের আস্থা। NGO ও গুলো এপর্যন্ত উপকূলীয় জেলাসমূহে ২৭০টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করেছে।

গণসচেতনতা বৃদ্ধিঃ অজ্ঞতা ও নিরক্ষরতার কারণে আমাদের দেশের জনগণ বিভিন্ন কুসংস্কারে বিশ্বাসী। তারা তাদের মধ্যে বিরাজমান সুপ্ত প্রতিভা ও ক্ষমতা সম্পর্কে একেবারেই অসচেতন। NGO সমূহ এরূপ পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে। ফলে জনগণের মাঝে আত্ননির্ভরশীল হওয়ার চেতনা সৃষ্টি হয়। তারা আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে এগিয়ে আসে।

স্বনির্ভর কর্মী সৃষ্টিতেঃ কর্মসংস্থানের অভাবে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত যুবক বেকারত্বের অভিশাপে ভুগছে। NGO সমূহ এসব বেকার যুবকদের কারিগরি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পুঁজি প্রদানের মাধ্যমে স্বনির্ভর কর্মী সৃষ্টিতে সহায়তা ভূমিকা রাখে।

স্বাস্থ্য সেবাঃ স্বাস্থ্য হলো উন্নয়নের চাবিকাঠি। এ লক্ষ্যে NGO গুলো স্বাস্থ্য সেবা সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। বেশকিছু NGO সমূহ পরিবার পরিকল্পনা, কুষ্ঠ রোগ নিরাময়,শিশু ও মায়ের সেবা, শিশুদের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, পুষ্টি বিষয়ে জ্ঞানদান ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণ প্রভৃতি কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণঃ জনবিস্ফোরণ বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। NGO গুলো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করেছে।

অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত উন্নয়নঃ দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ব্যতীত অর্থনৈতিক উন্নয়ন আশা করা যায় না। NGO সমূহ রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট, বাঁধ, সেতু ইত্যাদি নির্মাণ ও সংস্কার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি সরবরাহ প্রভৃতি উন্নয়ন মূলক কাজে এগিয়ে এসেছে। অবকাঠামোগত এসব উন্নয়নের ফলে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা বাণিজ্য তথা সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের মত একটি অনুন্নত দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে NGO সমূহের প্রয়োজন বা অবদান অনস্বীকার্য। তবে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে দেশের মানুষকে শিক্ষিত করে উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন এনে ধীরে ধীরে NGO নির্ভর কমাতে। এতে নিজেদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ হবে। এবং দেশের উন্নতি সাধন করা সম্ভব হবে।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

Top